মৌলভীবাজারে আমন ধান আবাদে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা। তবে জেলার অন্যতম বড় হাওর কাউয়াদীঘিতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা, হাজার হাজার একর জমি এখন পানির নিচে। এতে পানিতে তলিয়ে গেছে আবাদি জমি আর বীজতলা। ফসল হারানোর শঙ্কায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড দিন-রাত পাম্প চালু রাখলেও কুশিয়ারা নদীতে নামছে না হাওরের পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি হাওরের নিচু অঞ্চলে আমন ধান রোপণ করায় তা পানিতে ডুবে যায়। হাওরের নিচু অঞ্চলে আমন রোপণ করতে হলে হাওরের পানির লেভেল ৭.৫০ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন পাম্প হাউজ নির্মাণ করতে হবে। কৃষকরা বলছেন, দ্রুত পানি নামানো না গেলে হাজারো একর জমির আমন চাষ ব্যর্থ হবে। অন্যদিকে কৃষি বিভাগ আশা করছে, বর্তমান পরিস্থিতি সত্ত্বেও মৌলভীবাজারে এবারও লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি আমন আবাদ সম্ভব হবে।
সরেজমিনে সদর উপজেলার বড়কাপন, জগতপুর, রায়পুর, আখাইলকুড়া, কাশিমপুরসহ হাওরপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, কোথাও ডুবে আছে বীজতলা, আবার কোথাও সদ্য রোপণ করা আমন চারার জমিও পানিতে নিমজ্জিত। বর্ষার শেষ দিকে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জলাবদ্ধতা দেখা দেওয়ায় অনেক কৃষক এখনো আমন লাগাতে পারেননি।
মিরপুর গ্রামের কৃষক সোহেল মিয়া জানান, প্রত্যেক বছর জলাবদ্ধতায় আমাদের সবকিছু কাড়িয়া লইয়া যায়। অনেক টাকা পয়সার ক্ষতি হয়। এই পানি নিষ্কাশন না হওয়ার কারণে আমাদের মতো অনেক গৃহস্থ ক্ষতিগ্রস্ত হই। পানি ঠিকমতো তারা হিছে না। পানি না হিছার কারণ কিতা ইটা আল্লায় কইতান পারইন।
একাটুনা গ্রামের কৃষক সেলিম মিয়া জানান, ‘আমাদের চারাগুলো পানির নিচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভাদ্র মাসের মধ্যে পানি না নামলে যে হালিগুলো গজাইছে সেগুলোও শেষ হয়ে যাবে। এখনই পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করলে ব্যাপক ক্ষতি হবে।’
কচুয়া গ্রামের কৃষক রেজাউল বলেন, ‘হাওরে ৮টা পাম্প মেশিন থাকলেও সেগুলো সঠিকভাবে চালানো হয়নি। যদি চালানো হতো তবে ১৯ হাজার হেক্টর জমি ডুবে যেত না। এখন নতুন করে পাম্প চালু করতে হবে।’
হাওর রক্ষা আন্দোলনের সদর উপজেলা সভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, কাউয়াদীঘি হাওর কিনারে এখন আমন আবাদের ভরা মৌসুম। আমরা অনেকেই বীজতলা তৈরি করেছি, কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে ধান রোপণ সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার আবেদন করেও কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি। যার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। তিনি জানান, হাওরের সঙ্গে সংযুক্ত খাল নালা বা ছোট নদী যদি খনন করা হতো তাহলে পানির ধারণক্ষমতা বাড়ত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর মৌলভীবাজার জেলায় ৯৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘কাউয়াদীঘি হাওরের কাশিপুর পয়েন্টে পাম্পগুলো ২৪ ঘণ্টা চালু আছে। এগুলো সচল থাকলে আমন আবাদে বড় ধরনের বিঘœ ঘটবে না। আমরা আশা করছি ৯ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে আবাদ হবে।’
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলীদ জানান, পাম্প হাউজ প্রধানত করা হয়েছিল মে-জুন মাসে বোরো ফসলের সময় আগাম বন্যা বা বৃষ্টিপাতের ফলে ছড়ার পাহাড়ি ঢল নেমে আসে তাতে হাওরের পাকা ধান যাতে ডুবে না যায় সে জন্য। সাধারণত হাওর এলাকায় হাওরের কান্দিতে আমান ধান উৎপাদন হলেও হাওরের নিচু অঞ্চলে আমন ধান উৎপাদন সম্ভব হয় না। আগস্ট মাসের ডিজাইন লেভেল হতে হাওরে পানির সমতল কম থাকলেও বর্তমানে হাওরের নিচু অঞ্চলে আমন ধান রোপণ করায় তা পানিতে ডুবে যায়।
তিনি বলেন, বর্ষাকালে ছড়ার মাধ্যমে যে পরিমাণ পানি আসে সে পরিমাণ পানি বর্তমান পাম্প হাউজের মাধ্যমে নিষ্কাশন সম্ভব না। হাওরের নিচু অঞ্চলে আমন রোপণ করতে হলে হাওরের পানির লেভেল ৭.৫০ রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন পাম্প হাউজ নির্মাণ করতে হবে। তা ছাড়া বর্ষাকালে হাওরের পানির লেভেল ৭.৫০ রাখলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে কি-না সে বিষয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা প্রয়োজন।
বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলীদ বলেন, ‘পাম্প হাউজ মূলত মে-জুনে বোরো ফসল রক্ষায় নির্মিত হয়েছিল। আমন ধান সাধারণত হাওরের কান্দিতে চাষ হয়, কিন্তু নিচু জমিতে করলে পানিতে ডুবে যায়। নিচু জমিতে আমন রোপণ করতে হলে হাওরের পানির লেভেল ৭.৫০ মিটার রাখতে হবে। এ জন্য নতুন পাম্প হাউজ প্রয়োজন।