- ডেমরা-চনপাড়া সেতু: পরিত্যক্ত ঘোষণা হলেও ব্যবহার চলছে
- ইছাপুরা সেতু: ৩২০ মিটার নতুন সেতুর কাজ ২০২১-এ শেষ হওয়ার কথা, এখনো ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন।
- নগরপাড়া-কায়েতপাড়া সেতু: ১ বছরের প্রকল্প ২২ বছরেও শেষ হয়নি, নদীতে স্প্যান ভেসে আছে।
- কেওঢালা সেতু: ৯৩ কোটি টাকার প্রকল্প, জমি অধিগ্রহণ ঝামেলায় থেমে গেছে।
ঢাকার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষায় রূপগঞ্জের বালু নদীতে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি সেতু। তবে অন্তত চারটি সেতু এখন রূপগঞ্জসহ দেশের পূর্বাঞ্চলীয় মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতি, টেন্ডার, মেয়াদ বৃদ্ধি সবই হয়েছে, হয়নি শুধু কাজের সমাপ্তি। ফলে প্রতিদিন ঝুঁকি আর ভোগান্তি নিয়ে সেতু পার হচ্ছেন কয়েক লাখ মানুষ।
এ যেন বাতির নিচে অন্ধকারের গল্প। রাজধানীর পূর্ব প্রবেশমুখ রূপগঞ্জে গড়ে তোলা ছয়টি সেতুর মধ্যে দুটি (রাজউকের পূর্বাচল ও সেনাবাহিনীর জলসিঁড়ি সেতু) ছাড়া বাকিগুলো হয় পরিত্যক্ত, নয়তো বছরের পর বছর ঝুলে আছে নির্মাণকাজ।
১৯৯১ সালে নির্মিত ডেমরা-চনপাড়া সেতু এখন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। ফেটে গেছে পিলার, বেরিয়ে আছে রড। এক যুগ আগে এটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও হয়নি সংস্কার বা নতুন করে নির্মাণ। তবু প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে এটি ব্যবহার করছে মানুষ।
ডেমরা-চনপাড়া ঘাটের মাঝি কামাল হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা অনেক দুঃখের বিষয়। এখানে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। লোহার গাড়ির মতো কাঠামো দেখে মানুষ ভয়ে পার হতে চায় না। সবাই বলে, ব্রিজ দিয়ে আর যাওয়া যাবে না। আমরা যারা নৌকা চালাই, তারাও আতঙ্কে থাকি। এই অবস্থা যেকোনো সময় প্রাণঘাতী হতে পারে। আগেও ট্রলারে কয়েকজন মানুষ মারা গেছে। তাই আমরা সরকারের কাছে আবেদন করছি, এ জায়গার কাজ যেন দ্রুত শুরু করা হয়। না হলে প্রতিদিনই আমরা ভয় নিয়ে নৌকা চালাতে বাধ্য হবো।’
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা আরিফ বলেন, ‘ডেমরা-চনপাড়া সড়কটি মূলত রূপগঞ্জ ও ঢাকার মধ্যে প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রায় ১০-১৫ বছর ধরে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিন রূপগঞ্জের বহু ছাত্রছাত্রী ডেমরা বাউনি উচ্চবিদ্যালয় ও ডেমরা কলেজে পড়াশোনা করতে আসে। ছোট বাচ্চারা যখন এটি দিয়ে যাতায়াত করে, তখন বড় গাড়ি চলাচলের কারণে তাদের জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়। এটি সংস্কার করা এখন রূপগঞ্জবাসীর সময়ের দাবি। যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, অতি দ্রুত যেন এ ব্রিজের সংস্কারকাজ শুরু করা হয়।’
১৯৯৬ সালে নির্মিত ইছাপুরা বেইলির পরিবর্তে ২০১৮ সালে শুরু হয় নতুন ৩২০ মিটার দীর্ঘ সেতুর কাজ। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো শেষ হয়নি ৭৫ শতাংশ। কর্তৃপক্ষ নকশা জটিলতাকে দায়ি করছে, কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ এটি কেবল অজুহাত। ফলে কয়েক লাখ মানুষকে প্রতিদিন বিকল্প পথ ঘুরে অতিরিক্ত সময়, অর্থ ও পরিশ্রম ব্যয় করতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে হচ্ছে নৌকা পারাপার।
২০০৩ সালে ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু হয়েছিল নগরপাড়া-কায়েতপাড়া সেতুর কাজ। এক বছরের প্রকল্প হলেও ২২ বছর পেরিয়ে গেছে, হয়নি সমাপ্তি। নদীতে ভেসে থাকা চারটি স্প্যান এখন নৌযান চলাচলেও বাধা সৃষ্টি করছে। ২০২১ সালে দ্বিতীয়বার টেন্ডার হলেও আবারও বন্ধ হয়ে যায় কাজ। ফলে রাজধানী থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে থেকেও এলাকার মানুষকে নৌকায় পারাপার করতে হয় অথবা ২০ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় কেওঢালা সেতুর কাজ। তবে জমি অধিগ্রহণ ছাড়া কাজ শুরু হওয়ায় স্থানীয়দের বাধার মুখে থেমে যায় নির্মাণ। এরপর থেকেই অনিশ্চয়তায় কেওঢালা সেতু প্রকল্প।
এলাকাবাসীর দাবি, সেতুগুলো সময়মতো নির্মাণ বা সংস্কার হলে এ অঞ্চলের অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা ও শিল্পায়নে বড় ধরনের পরিবর্তন আসত। কিন্তু বারবার প্রতিশ্রুতি, টেন্ডার আর দেরির কারণে তারা আজও ভোগান্তির শিকার। মানববন্ধন, অবরোধ, বিক্ষোভ করেও সমাধান মেলেনি।
রূপগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী মো. আকতার হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ডেমরা-চনপাড়া সেতুটি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। বিভিন্ন লোড ও কার্গোর কারণে মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটে। আমরা এরই মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে মেরামত ও নতুন প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেছি এবং এলজিইআরের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সরকারি নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজ বাস্তবায়ন করা হবে।’
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে জানান, নগরপাড়া-কায়েতপাড়া ব্রিজ নির্মাণকাজের অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর। ২০০৪ সালের পাইলট প্রজেক্ট কার্যত ২০০২ সালেই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। নগরপাড়া সেতুর কাজ ২০১২ সালে উদ্বোধনের কথা থাকলেও ২০২২ সালেও আলোর মুখ দেখেনি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটি পরে সড়ক ও জনপথ বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী ওয়াটার লেভেল থেকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় ব্রিজ নির্মাণ করতে হয়, যা এখানে মানা হয়নি। সে কারণে সেতুটি বর্তমানে নির্মাণযোগ্য নয়। বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে।