ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শামুক নিধনে নড়াইলে পরিবেশ হুমকিতে

মো. তাহের, নড়াইল
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ০১:৪৮ এএম
  • নির্বিচারে আহরণ ও পরিবেশদূষণে বিলুপ্তির পথে শামুক
  • শামুক কৃষিজমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে
  • মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের কারণে শামুকের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে
  • মৎস্য বিভাগ স্বীকার করেছে, শামুক সংরক্ষণে কোনো কার্যক্রম নেই

শামুককে বল হয় নিরীহ জলজ প্রাণী। এটি জলজ পরিবেশ ও কৃষি ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক পোকামাকড় ও তাদের ডিম খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। এ ছাড়া ফসলি জমির উর্ব্বরতা বৃদ্ধিসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এ প্রাণীর ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু নড়াইলের খাল-বিল ও জলাশয় থেকে বেপরোয়া আহরণ, জমিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশদূষণ ও মৎস্য বিভাগের উদাসীনতায় পরিবেশের উপকারী বন্ধু জলজপ্রাণী শামুক আজ বিলুপ্তির পথে।

প্রতিদিনই নির্বিচারে শামুক নিধনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী শামুকের বংশ বিস্তার হুমকির মুখে পড়েছে। এ কারণে এই জেলায় একসময় খাল-বিল ও জলাশয়ের পানিতে প্রচুর পরিমাণে শামুক দেখা গেলেও এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না। ফলে প্রাণীটির বিলুপ্তির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি কৃষিজমির ক্ষতি হচ্ছে।

এদিকে জেলার বিভিন্ন মাছের ঘের মালিক ও মৎস্যচাষিরা মাছের খাবার হিসেবে শামুক ব্যবহার করায় বিলুপ্তির পথে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীটি। গ্রামের এক শ্রেণির মানুষ লাভের আশায় বিল থেকে অবাধে শামুক সংগ্রহ করে তা ঘের মালিক ও মৎস্যচাষিদের কাছে বিক্রি করছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও শামুক সংরক্ষণে জেলা মৎস্য বিভাগ উদাসীন।

জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, কৃষিনির্ভর এ জেলায় রয়েছে বিস্তীর্ণ কৃষিজমি। আর এসব জমির অধিকাংশই বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে থাকে। এসব জলাভূমির কৃষি জমিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় শামুক। শামুক একটি নিরীহ জলজ প্রাণী হওয়ায় তা সহজেই ধরে বিক্রি করছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সি নারী-পুরুষ। ফড়িয়ারা (মধ্য স্বত্বভোগী)  গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে শামুক কিনে তা বিভিন্ন মোকাম (বড় ধরনের হাট) ও ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। 

বর্তমানে কেজিপ্রতি শামুক ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা এসব শামুক কিনে জেলাসহ বিভিন্ন মোকাম ও মাছের ঘের মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। তারপর এ শামুক ভেঙে এর নরম অংশ বের করে তা দিয়ে মাছের খাদ্য তৈরি করা হয়।

এদিকে শামুক সংরক্ষণে মৎস্য বিভাগের পর্যাপ্ত উদ্যোগ ও নজরদারির অভাব রয়েছে। ফলে শামুক নির্বিচারে নিধন হচ্ছে। মৎস্যচাষিরা মাছের খাবার হিসেবে শামুক ব্যবহার করছেন।

সদর উপজেলার বিছালী ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জ্যোতি বিশ্বাস জানায়, পড়ালেখার পাশাপাশি সে প্রতিদিন স্থানীয় বিল থেকে শামুক সংগ্রহ করে ২০০-৩০০ টাকা বিক্রি করেন।

কালিয়া উপজেলার আমবাড়িয়া গ্রামের দিনমজুর কালু মিয়া শেখ (৪০) জানান, সংসার চালানোর জন্য তিনি স্থানীয় বিভিন্ন বিল-খাল থেকে শামুক সংগ্রহ করে ঘের মালিক ও মৎস্যচাষিদের কাছে বিক্রি করে থাকেন। এতে তার প্রতিদিন প্রায় ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়ে থাকে, যা দিয়ে তিনি সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। 

সিবানী বিশ্বাস নামের এক নারী বলেন, ‘বর্ষার মৌসুমে প্রতিদিন সকালে বিল থেকে আমাদের এলাকার অনেক নারী-পুরুষ শামুক সংগ্রহ করেন। সংগ্রহ শেষে তারা মৎস্যচাষিদের কাছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। এতে তাদের প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা বাড়তি আয় হয়।’

সদর উপজেলার বড়েন্দা এলাকার ঘের মালিক কামাল হোসেন জানান, তৈরি ফিস ফিড অপেক্ষা সহজলভ্য ও মাছের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক বলে তাদের অনেকেই শামুক ব্যবসায়ীদের দাদন দিয়ে শামুক কিনে থাকেন।

একই এলাকার মৎস্যচাষি পলাশ বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা ৩০ টাকা কেজি দরে শামুক কিনে মাছকে খাওয়ায়। এতে মাছের বৃদ্ধিও ভালো হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘শামুকে যে জীবাণু থাকে আর সেই জীবাণু মাছে যায়, এটা আমার জানা ছিল না। এ বিষয়ে মৎস্য অফিস থেকে আমাদের কখনো কিছু বলা হয়নি। মৎস্য অফিস থেকে কখনো কেউই আমাদের এখানে আসেননি। তারা আমাদের কোনো খোঁজখবরও নেন না।’

সদর ও কালিয়া উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু রায়হান বলেন, শামুক পরিবেশ তথা কৃষির ক্ষেত্রের জন্য খুবই উপকারী প্রাণী। শামুক কৃষিজমিতে ফসল বিনষ্টকারী বিভিন্ন পোকা ও পোকার ডিম খেয়ে ফসল রক্ষা করে থাকে। এ জন্য শামুক নিধন না করে দরকার আরও শামুক চাষের। এতে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা পাবে।

তিনি আরও বলেন, ‘শামুক সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় মাছের খাদ্য হিসেবে শামুকের ব্যবহার আমরা নিরুৎসাহিত করে থাকি। কাঁচা শামুক খাওয়ানোর ফলে মাছের শরীরে রোগ জীবাণু এবং গ্যাসের সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে ওই মাছ খেলে মানুষের শরীরেও নানা রোগ-জীবাণু ছড়ায়। এ কারণে শামুক মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার না করার জন্য ঘের মালিকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।’

জেলা মৎস্য বিভাগের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘শামুক সংরক্ষণে আমাদের কোনো কার্যক্রম নেই।’