ঢাকা শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর, ২০২৫

ব্যস্ততম ডকইয়ার্ডগুলোতে এখন নীরবতা

নাছরুল্লাহ আল কাফী, পিরোজপুর
প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৫, ০৩:৩৯ এএম

*** কর্মহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় আড়াই হাজার দক্ষ শ্রমিক
*** গত দুই বছরে বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত সাতটি ডকইয়ার্ড

পিরোজপুরের নেছারাবাদে এক সময়ের ব্যস্ততম ডকইয়ার্ডগুলোতে এখন নীরবতা। ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩০টি ডকইয়ার্ডের মধ্যে গত দুই বছরে অন্তত সাতটি বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় আড়াই হাজার দক্ষ শ্রমিক। বাকি ডকগুলোও টিকে থাকার লড়াই করছে।

বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের ২৭ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত সন্ধ্যা নদীর দুই তীরে ঘেঁষে ছারছিনা, নান্দুহার, কালীবাড়ি, বালিহারী, মাগুরাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে গড়ে ওঠে নেছারাবাদের ডক শিল্প। ৩৫ বছর আগে বরছাকাঠির আবদুল বারেক ও রুস্তম আলীর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় এই শিল্পের। তখন থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে প্রায় ৩০টিরও বেশি ডকইয়ার্ড। এই ডকইয়ার্ডগুলোতে বছরে তৈরি হতো প্রায় ২০০টি নৌযান। মেরামত করা হতো আরও দেড় থেকে দুই হাজার নৌযান। এখানে ৫০ লাখ থেকে শুরু করে ১০ কোটি টাকা মূল্যের জাহাজ নির্মাণ হতো, যার মধ্যে ছিল লঞ্চ, উন্নতমানের ট্রলার ও বড় আকারের কার্গো জাহাজ। ২০০-২৫০ ফুট দীর্ঘ নৌযান নির্মাণে সময় লাগতো প্রায় ৯-১০ মাস। ‎ কিন্তু করোনার পর থেকে হঠাৎ ভাটা পড়ে এই শিল্পে। কাঁচামালের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি, জ্বালানি সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং সড়ক-রেলপথে পরিবহনের ওপর নির্ভরতা বাড়ায় ডক শিল্পে ধস নামে। বর্তমানে সীমিত পরিসরে কেবল মেরামতের কাজ চলছে।

‎নেছারাবাদ উপজেলার ডকইয়ার্ডগুলোতে দেখা যায়, কয়েকটি ডকইয়ার্ডে কমপক্ষে ৫০-১০০ জন শ্রমিকের জায়গায় কাজ করছে মাত্র ২০-২৫ জন। বিশাল আকারের জাহাজ নির্মাণের জায়গাগুলো খালি পড়ে আছে। আগের মতো লোহার শব্দ নেই। নদীর পাড়ে পড়ে থাকা জাহাজের খোলা খোলস যেন কথা বলছে একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের জীর্ণ দশার।

‎স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং পরিকল্পিত উদ্যোগ না থাকলে এই শিল্প পুরোপুরি বিলুপ্তির পথে যাবে। অথচ নেছারাবাদের ডকইয়ার্ড শিল্প দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি সম্ভাবনাময় খাত হতে পারত।

‎নুরুল হায়দার নামে এক শ্রমিক বলেন, আমি প্রায় ১৮ বছর ধরে এই কাজ করি। ডকইয়ার্ডে এখন তেমন কাজ নেই। যে মজুরি পাই তাতে আমাদের সংসারও চলে না। সরকার যদি আমাদের একটা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিত যদি একটা সার্টিফিকেট এর ব্যবস্থা করত তাইলে আমরা অন্য জায়গায় গিয়েও কাজ করতে পারতাম।

নাজমুল ইসলাম নামে আরেক শ্রমিক বলেন, আগে দিনে ৭০০-৮০০ টাকা রোজগার হতো, এখন বসে থাকতে হয়। যদি সরকার কিছু সহযোগিতা করত, এই শিল্প আবার দাঁড়াইত। নইলে আমাদের সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে।

‎জাহাজমালিক কামরুল ইসলাম বলেন, মূলত এই জাহাজ ব্যবসা আগের মতো আর নেই। করোনার পরে বিদেশি জাহাজ এখন আর বাংলাদেশে আসে না। এ কারণে আমরা জাহাজের কাঁচামাল এবং পুরাতন জাহাজের মাল পাচ্ছি না। এ কারণে কাঁচামালের দামও বেশি সব মিলিয়ে আমাদের জাহাজ ব্যবসা এখন আর আগের মতো নেই। এই ব্যবসায় সরকার যদি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াত তবেই ব্যবসাটি টিকে থাকত।

স্থানীয় এক সংবাদকর্মী আজিজুল ইসলাম বলেন, জাহাজের কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে বেশকিছু ডকইয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বর্তমানে কিছু ডকইয়ার্ডের কার্যক্রম চলছে। এখানকার ডকইয়ার্ডগুলোর প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি পড়লে এগুলো ভালো চলত।

নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, নেছারাবাদ উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা- রয়েছে এর মধ্যে ডকইয়ার্ড শিল্প গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। নিজস্ব উদ্যোগে এখানের কিছু মানুষ এ উপজেলার সন্ধ্যা নদীর তীরে ডকইয়ার্ড শিল্প গড়ে তুলেছে। ডকইয়ার্ড শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের নিয়ে গত বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলাম। যাতে করে তারা এই কাজটি ভালো করে করতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গড়তে ভূমিকা রাখতে পারে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন সার্বিক খেয়াল রাখছে।

‎এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহজ শর্তে ঋণ, কাঁচামালের সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ, প্রশিক্ষণ সুবিধা এবং সরকারি তদারকি থাকলে এ শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে।