ঢাকা শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর, ২০২৫

অভাবের কিশোর থেকে অনুপ্রেরণার আইকন

সজীব আলম, লালমনিরহাট
প্রকাশিত: অক্টোবর ৩, ২০২৫, ০৩:৫৯ এএম

অভাব-অনটনের বেড়াজালে শৈশব পার করা সেই কিশোর আজ লালমনিরহাটের পরিচিত মুখ মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে। তিনি শিহাব আহমেদ। কখনো সবজি বিক্রেতা, কখনো ট্রাকের হেলপার কিংবা রিকশাচালক হয়ে বেড়ে ওঠা এই তরুণ এখন শুধু ব্যবসায়ী নন, সমাজসেবায়ও রেখেছেন অসাধারণ অবদান।

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বড়খাতা ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজের সপ্তম সন্তান শিহাব আহমেদ। ১৯৯৫ সালে জন্ম নেওয়া শিহাব দুই বছর বয়সেই মাকে হারান। এরপর নানির স্নেহে ও আত্মীয়দের আশ্রয়ে তার বেড়ে ওঠা। দারিদ্র্যের চাপে শৈশবেই জীবিকার খোঁজে নানা পেশায় যুক্ত হলেও  কখনো পড়াশোনা ছাড়েননি। বাজারে সবজি বিক্রি, রিকশা চালানো ও ট্রাকের হেলপার হিসেবে কাজ করতে করতেই ২০১৪ সালে বড়খাতা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ অর্জন করেন। এরপর অভাব অনটনের সংসারে জীবিকার প্রয়োজনে বিদেশে পাড়ি জমান শিহাব। তবে বিদেশে থেকেও ভুলে যাননি গ্রামের মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা। দেশে ফিরে আসেন অভিজ্ঞতা ও সাফল্যের আলোয় আলোকিত হয়ে। তারপর ব্যবসার পাশাপাশি নিজেকে যুক্ত করেন মানবিক কর্মকা-ে।

অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে শিহাব আহমেদের ভূমিকা ব্যাপক। তিনি হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার ২৫ হাজারের বেশি পরিবারে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করেছেন। এক হাজারেরও বেশি মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় অজুখানা স্থাপন করেছেন এবং নির্মাণ করেছেন ১৫টি মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানা। কোরবানির মাধ্যমে দুই হাজারেরও বেশি গরু ও ছাগল বিতরণ করেছেন দরিদ্র পরিবারের মধ্যে।

করোনা মহামারি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় ২০ হাজার পরিবারে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। গৃহহীন ১০টি পরিবারকে দিয়েছেন পুনর্বাসনের সুযোগ। শারীরিক প্রতিবন্ধী ১০০ জনের বেশি মানুষকে দিয়েছেন হুইলচেয়ার। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা শুরু করতে আর্থিক সহায়তা করেছেন, অসংখ্য দরিদ্র রোগীর চিকিৎসা খরচ বহন করেছেন এবং ৩ লক্ষাধিক মানুষের জন্য একবেলা গরম খাবার ও ইফতার বিতরণ করেছেন।

শুধু মানবিক সহায়তাই নয়, শিক্ষা উন্নয়নেও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ২১০টি ‘শিহাব আহমেদ শিশু বিকাশ একাডেমি’। এছাড়া শতাধিক মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য চালু করেছেন ‘শিহাব আহমেদ শিক্ষাবৃত্তি’। এ বৃত্তির বিশেষ শর্ত হলো- শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে গিয়ে অন্তত একজন দরিদ্র মেধাবীর দায়িত্ব নিতে হবে।

মানবিক কার্যক্রমের পেছনের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে শিহাব আহমেদ বলেন, ‘ব্যবসার মুনাফা আমার কাছে শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার হাতিয়ার। ছোটবেলা থেকেই মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে বড় হয়েছি। তাই সমাজসেবাকে জীবনের অংশ করেছি। যখন কোনো অসহায় মানুষকে সাহায্য করে তার মুখে হাসি ফুটাতে পারি, তখন মনে হয় মায়ের মুখেই সেই হাসি দেখছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি। কিন্তু আজ অসহায় মানুষের মুখে যে হাসি দেখি, সেখানে আমি মায়ের মুখাবয়ব খুঁজে পাই। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।’

স্থানীয়রা জানান, ব্যবসায়ী হয়েও শিহাব যেভাবে মানবিক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন, তা তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা। তাদের ভাষায়, শিহাব শুধু উদ্যোক্তা নন, তিনি এই অঞ্চলের প্রকৃত ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’।