শনিবার, ১৯ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


ফাহিম হাসনাত

প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২৫, ০১:৪১ এএম

নরসিংদীর হারানো ঐশ্বর্যের গল্প

ফাহিম হাসনাত

প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২৫, ০১:৪১ এএম

নরসিংদীর হারানো ঐশ্বর্যের গল্প

নরসিংদীর মাটি যেন নিজ হাতে ফলের ঝাঁপি সাজিয়ে বসে আছে। সুগন্ধি সাগর কলা, রসালো ঘোড়াশালের আনারস আর মুখরোচক লটকন- এই তিনটি ফল যেন নরসিংদীর তিন রতœ। একসময় 
এই তিন ফলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। আজও তাদের গন্ধ-রং-রস গায়ে মেখে বহন করে বেড়ায় এক ঐতিহ্যবাহী কৃষির গল্প, একটি জেলার হৃদয়ের ইতিহাস।

কলা :
নরসিংদীর হারানো গৌরব : নরসিংদীর নাম উঠলেই সবার প্রথমে মনে আসত কলার কথা। বাণিজ্যিকভাবে চাষ না হলেও বুনো কলা, কাঁঠাল আর আনারসের স্বাদ উপভোগ করত এলাকাবাসী। সময়ের পরিক্রমায় এখানকার কলাবাগানগুলো তৈরি করেছিল এক মনোমুগ্ধ করা দৃশ্য। নরসিংদীর কলার স্বাদ, গন্ধ আর গুণাগুণ ছিল অতুলনীয়, যার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। বাংলার অনেক শাসক তাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় নরসিংদীর কলা রাখতেন।

কলার এতটাই কদর ছিল যে, পাটের পরেই এটি ছিল নরসিংদীর মানুষের দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী ফসল। কলা চাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এক শক্তিশালী স্থানীয় অর্থনীতি। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, নরসিংদীর পাহাড়ি ও সমতল ভূমির বয়স প্রায় ১০ হাজার বছর। কলার উৎপত্তিস্থল এশিয়া হওয়ায় ধারণা করা হয়, কৃষির শুরু থেকেই, এমনকি ধান চাষের সমসাময়িক কাল থেকেই নরসিংদীতে কলা চাষ হতো।

ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে কলা চাষ হতো। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জুড়েই ছিল সুস্বাদু সাগর কলা। এ ছাড়াও সবরি, কবরি, চম্পা, চিনিচম্পা, অগ্নিসাগরসহ বিভিন্ন জাতের কলার চাষ হতো। উৎপাদিত কলার পরিমাণ ছিল প্রায় ৮০ লাখ টন। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল প্রায় এক থেকে দেড় লাখ মানুষ।

নরসিংদী থেকে উৎপাদিত কলা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকি রাজধানীতেও রপ্তানি করা হতো। পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি লোকাল ট্রেনের নামকরণ করা হয়েছিল ‘কলার গাড়ি’। প্রতিদিন বিকেলে দৌলতকান্দী, শ্রীনিধি, মেথিকান্দী, খানাবাড়ী, আমীরগঞ্জ, নরসিংদী, জিনারদী, ঘোড়াশালসহ বিভিন্ন রেলস্টেশনে হাজার হাজার টুকরি কলা জমা হতো, যা সন্ধ্যার পর কলার গাড়িতে তুলে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেললাইনে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রেনেই কলার বগি থাকত। শত শত হকার ট্রেনের কামরায় নরসিংদীর পাকা কলা বিক্রি করতেন। একইভাবে লঞ্চ, স্টিমার ও বাসেও নরসিংদীর কলার সরব উপস্থিতি ছিল। নতুন জামাইরা শ্বশুরবাড়ি গেলে ডাউস আকারের হলদে পাকা সাগর বা সবরি কলার কাঁদি নিয়ে যেত, যা তাদের কদর আরও বাড়িয়ে দিত।

চিকিৎসকদের মতে, পরিশ্রমী মানুষের জন্য পাকাকলা অত্যন্ত উপকারী। প্রচুর ক্যালরি থাকায় এটি শক্তি যোগায়। পুরোনো দিনের মানুষও এই তথ্য জানত। বাগানে কলা পাকলে চাষিরা আস্ত কলার ছড়ি কেটে মেয়ের জামাইয়ের বাড়িতে পাঠাত। কলার অতিরিক্ত পুষ্টি ও ঔষধি গুণের কারণে কবিরাজরা রোগীদের কলা খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। এমনকি দুধেল গাভীকেও অতিরিক্ত দুধের আশায় পাকাকলা খেতে দেওয়া হতো। কলার এই বহুমুখী ব্যবহারের কারণেই নরসিংদীর মানুষ পাহাড়ি ও সমতল ভূমিতে আনন্দের সঙ্গে কলা চাষ করত। সবচেয়ে বেশি কলা চাষ হতো মনোহরদী উপজেলায়, যেখানে চালাকর, সাগরদী, মনোহরদী, হাতিরদিয়াসহ বেশ কয়েকটি কলার বাজার গড়ে উঠেছিল। এসব বাজার থেকে ট্রাকে ভর্তি হয়ে কলা যেত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। পলাশের চরসিন্দুর, গজারিয়া, তালতলী, পারুলিয়া, কালির বাজার, রাবান বাজার, চরনগরদী, নরসিংদীর ভাটপাড়া, শীলমান্দী, শিবপুরের ফতেপুর, সিএন্ডবি, পালপাড়াসহ অন্যান্য বাজারেও হাজার হাজার টন কলা আমদানি ও রপ্তানি হতো।

সুদিনের অবসান ও বর্তমান অবস্থা : দুঃখজনক হলেও সত্য, নরসিংদীর কলার সেই সুদিন আর নেই। কলা চাষ এখন ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে পৌঁছেছে। 

বিশেষ করে দেশি জাতের সুস্বাদু ও সুগন্ধি সাগর কলার উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এর স্থান দখল করেছে নেপালি সাগর কলা, যা স্বাদে ও গন্ধে ততটা ভালো না হলেও ফলন বেশি এবং রোগবালাই কম। এ ছাড়াও চম্পা ও সবরি কলার চাষ হচ্ছে, তবে চাষিরা কাক্সিক্ষত উৎপাদন পাচ্ছে না।
সচেতন চাষিরা বলছেন, দেশি জাতের সাগর কলা আমাদের ঐতিহ্য। এই কলার জাত সংরক্ষণে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে কাজ করতে হবে। গবেষকরা যদি নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে দেশি জাতের সাগর কলার উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে পারে, তবেই চাষিরা আবার কলা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

আনারস : কলা ছাড়াও নরসিংদীর আরেকটি জনপ্রিয় ফল হলো আনারস। এটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ, সুস্বাদু ও রসালো একটি ফল। দেখতে সুন্দর এই ফলটি কলি অবস্থায় লাল, পরে সবুজ এবং খাওয়ার উপযোগী হলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এর ওজন সাধারণত ৪০০-২০০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। বাংলাদেশে মূলত তিন জাতের আনারস দেখা যায়: জলডুবি, ক্যালেঙ্গা বা ক্যালেন্ডার এবং ঘোড়াশাল। নরসিংদী জেলার ঘোড়াশাল অঞ্চলে চাষ হওয়া আনারসের নামকরণ করা হয়েছে ‘ঘোড়াশাল’ আনারস।

পলাশ উপজেলার রাবান, জিনারদি ও আশপাশের অঞ্চল এবং বেলাবো উপজেলার পাটুলি, বাজনাব, আমলাব ও তার আশপাশের এলাকার চাষিরা আনারস চাষ করে বছরে প্রায় ৩০-৫০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। বর্তমানে হানিকুইন নামের এক প্রজাতির আনারসের চাষ বেশি হচ্ছে, যার পূর্বের নাম ছিল জলডুবি। বর্তমানে এ জেলার ঘোড়াশাল-বেলাবো অঞ্চলে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হচ্ছে। এই কৃষি পণ্যটি এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চাষ হওয়ায় চাষিরা ততটা লাভবান হতে পারছেন না। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করা হলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হতেন। আনারসে রয়েছে ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি-৬, ভিটামিন-সি, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়ামসহ নানা পুষ্টিগুণ, যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

লটকন : নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার অসংখ্য ফলের মধ্যে লটকন একটি অত্যন্ত মুখরোচক, টক-মিষ্টি স্বাদের ফল। ছোট গোলাকার হলুদাভ এই ফলটিকে ইংরেজিতে বার্মিজ গ্রেপ (ইঁৎসবংব এৎধঢ়ব) বলা হয়, যার বৈজ্ঞানিক নাম ইধপপধঁৎবধ ৎধসরভষড়ৎধ। এই রসালো ও মজাদার ফলের ভেতরে ২ থেকে ৪টি বীজ কোয়ার মতো থাকে এবং বীজের চারপাশ ঘিরে এক প্রকার রসালো পদার্থ থাকে যা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এই ফলের ঘ্রাণও বেশ মনোরম। দেশে ও বিদেশে এই ফলের চাহিদা থাকার কারণে নরসিংদী জেলার শিবপুরের পাহাড়ি এলাকা, বেলাবো ও মনোহরদী উপজেলার শত শত চাষি বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ করছেন এবং ফল বিক্রি করে বছরে এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করে থাকেন। লটকন গাছ মাঝারি আকারের চিরসবুজ উদ্ভিদ, যা ২০-২৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। গাছের গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পুরো কা-জুড়ে থোকায় থোকায় ফল ধরে। একটি থোকায় ৭-১৫টি ফল ধরে থাকে এবং একেকটি ফলের ওজন ১৫-২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়। গাছ রোপণ করার দুই-তিন বছরের মধ্যেই ফল ধরা শুরু করে এবং ২০-৩০ বছর পর্যন্ত ফল দিতে থাকে। এই ফলের চাহিদা দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশেও ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সুস্বাদু ফলটির চাষ সম্প্রসারণ করা দরকার।

লটকনে প্রতি ১০০ গ্রামে রয়েছে ০.৯ গ্রাম খনিজ পদার্থ, ৯.২ কিলো ক্যালরি খাদ্য শক্তি, ১.৪২ গ্রাম আমিষ, ০.৪৫ গ্রাম চর্বি, ১০.০৪ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-১, ০.২০ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি-২, প্রায় ৫.৩৪ গ্রাম আয়রন। এ ছাড়াও এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রয়েছে অ্যাসকরবিক এসিড, এনজাইম, বায়োফ্ল্যাভোনয়েডস এবং খনিজ উপাদান ক্রোমিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এটি একটি মুখরোচক, টক-মিষ্টি সুস্বাদু ফল যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

নরসিংদীর এই ফলগুলো শুধু মাটির ফসল নয়, এগুলো এ অঞ্চলের মানুষের পরিশ্রম, ঐতিহ্য আর ভালোবাসার প্রতীক। কলার সুদিন ফেরাতে এবং আনারস ও লটকনের চাষ আরও সম্প্রসারণে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে নরসিংদী আবার তার পুরোনো গৌরব ফিরে পাবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!