বিভীষিকাময় সুগন্ধা ট্রাজেডির তিন বছর পার হতে চলছে আজ। ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বিকেল পাঁচটায় ছেড়ে আসা এমভি অভিযান ১০ ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে রাত সাড়ে তিনটায় ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। লঞ্চে থাকা যাত্রীদের মধ্যে ৪৯ জন আগুনে পুড়ে মারা যায়, ৭২ জন চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন।
অভিযান লঞ্চের দূর্ঘটনাটায় নিহত ৪০ জনের মধ্যে অনেক পরিবার কাটছে আর্থিক অস্বচ্ছলতায়। পরিবারের আয়ের প্রধান ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে আছে। গণকবরে দাফন দেয়া ৯ মরদেহের পরিবারের হদিস মেলেনি এখনো। নির্মিত হয়নি আজও স্মৃতি স্তম্ভ। অবেহলায় পড়ে আছে গণকবর, নেই কোন রক্ষণাবেক্ষণ।
বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, অগ্নি দূর্ঘটনায় নিহত অসহায় পরিবারের তালিকা যাচাই-বাছাই করে মানবিক ফান্ড থেকে দেয়া হবে আর্থিক সহয়তা। দূর্ঘটনায় নিহতের স্মরণে নির্মিত হবে স্মৃতি স্তম্ভ।
গত ২০২১ সালের (২৪ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত শুরু হয়। লঞ্চটি তখন নলছিটি উপজেলা অতিক্রম করছিলো। আগুন লাগার পরে লঞ্চটি নলছিটি ঘাটে ষ্টপেজ না করে এমনকি ঝালকাঠি ঘাটেও ষ্টপেজ করেনি। লঞ্চটিতে আগুন লাগার প্রায় ১ঘন্টা ধরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে চলতে থাকে। তখন দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে ছিল লঞ্চটিতে। পরে লঞ্চটি ঝালকাঠির দিয়াকুল নামক স্হানে গিয়ে নদীর তীরে নোঙর করে। তখন ভাগ্যক্রমে অনেক যাত্রী লঞ্চ থেকে তীরে নামতে পেরেছিল। অনেকে সাতরে তীরে উঠতে পারলেও অনেকের সলিল সমাধী হয় সুগন্ধা নদীতে। ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের পুরো টিম ঘটনাস্হলে এসে প্রায় দুই ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
সেদিনের ভয়াবহ লঞ্চ দূর্ঘটনার ট্রাজিডিতে ৪৯ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে পুড়ে মারা যায়। ৭২ জন যাত্রীকে বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। অনেকের অবস্থা আশংকা জনক হওয়ায় ঢাকায় জাতীয় বার্ন ইউনিটে প্রেরণ করা হয়। ঐসময় চিকিৎসারত অবস্থায় আরো তিন জনের মৃত্যু ঘটে। অনেকের লাশ বিষখালী নদীর চড়ে, জালেও আটকা পড়ে।
আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে থেকে তখন ২৬ জনের পরিচয় সনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যাওয়ায় ২৩ মরদেহের পরিচয় সনাক্ত করা যায়নি। ওই সব মরদেহের নমুনা সংরক্ষণ করে বরগুনার পোটকাখালী গনকবরে অজ্ঞাত পরিচয় ২১ কবরে দাফন করা হয়। এই ঘটনায় নৌ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম সচিব তোফায়েল আহমেদ কে প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি ঘোষণা করেন।
আগুনে যাত্রী পুরে যাওয়ার ঘটনায় ঐ বছরের (২৬ ডিসেম্বর) নৌ আদালতে ৮ জনকে আসামী করে মামলা করে। সেদিনই আদালতের বিচারক ও দায়রা জজ জয়নব বেগম গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারী করেন লঞ্চ মালিকসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। (২৭ ডিসেম্বর) দুপুর অভিযান লঞ্চ-১০ মালিক হামজালাল শেখকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই ঘটনায় লঞ্চের মালিক সহ ২৫ জনকে অজ্ঞতা রেখে বরগুনা মূখ্য বিচারিক আদালতে এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একটি মামলা দায়ের করে।
বরগুনা পোটকাখালী গণ কবরে দাফন করা অজ্ঞাতদের শনাক্ত করতে জেলা প্রশাসনের তত্বাবধানে ঢাকা সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের একটি টিম ২৩ মরদেহের পরিচয় সনাক্তের অনুকূলে ৪৮ স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করেন। যার মধ্যে ১৪ মরদেহের পরিচয় শনাক্ত হলেও অজ্ঞাত থাকে ৯ মরদেহের।
বরগুনা সদর উপজেলার গৌরীচন্না ইউনিয়নের মিতু আক্তার বলেন, ঢাকায় মায়ের চিকিৎসা শেষে একই পরিবারের ৬জনকে নিয়ে অভিযান লঞ্চে বাড়ি ফিরছিল। আগুন লাগার পরে লঞ্চটি যখন তীরে ফিরছিলো তখন মা লাফ দিতে গিয়ে পরে গেলে অপারেশন ক্ষতস্থানে আঘাত প্রাপ্ত হয়। এতে রক্তক্ষরণ হলে মা অসুস্থতা অবস্থায় মারা যায়। মিতু আক্তার আরো বলেন, ছেলেকে মায়ের সঙ্গে ধাক্কা দিয়ে কিনারে ফেলে ভাই এবং ভাইয়ের বৌকে খুঁজে আনতে গিয়ে লঞ্চ পুনরায় নদীতে ভাসতে থাকে। এসময়ে আমার শরীরে আগুন লাগলে জীবন বাঁচতে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেই। আড়াই ঘন্টা সাতার কাটার পর সকালে তীরে উঠতে পারি। সেদিনের মর্মান্তিক দূর্ঘটনার কথা ভোলার নয়। দূর্ঘটনাটা আড়াই ভরি স্বর্ণ সহ হারিয়েছি নগদ টাকা পয়সা। দুর্ঘটনার আজ তিন বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত আমাদের পরিবারের পাশে কেউ দাড়ায় নাই।
সেই রাতের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মো. সাদিকুর রহমান ইতালির ভেনিস থেকে মুঠোফোনে জানান, ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর সকালে ইতালি থেকে ঢাকায় এসে বিকেলে অভিযান ১০ লঞ্চ যোগে বরগুনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। বরিশাল ঘাট দেয়ার পর ঘুম ভেঙে যায়। এরপরে লঞ্চটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম হঠাৎ দেখতে পাই পিছনে আগুন লেগেছে। লঞ্চের স্টাফদের গাফিলতির কারণে সেদিন এতগুলো প্রাণ ঝড়ে গেলো। তারা পালিয়ে না গিয়ে যদি লঞ্চটি যখন ভিড়ছিলো তখন নোঙর ফেলতো মানুষ গুলো সহজেই নেমে যেতে পারতো। আমি ও আমার পরিবার নিরাপদে নেমে যেতে পারলেও চোখের সামনে পুড়তে দেখেছি মানুষকে। আজ তিন বছর পার হলেও এখনো দোষীদের বিচার হয়নি। দ্রুততম সময়ে তাদের বিচার হোক এটাই প্রত্যাশা।

 
                            -20241224133132.jpeg) 
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                    -20251031233315.webp) 
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                    -20251031164732.webp) 
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন