ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ জুন, ২০২৫

তিন দফা টোলে বিপাকে লামা-আলীকদমের কৃষক

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: জুন ১, ২০২৫, ১২:৫৬ পিএম
কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা একই কৃষিপণ্যের ওপর বারবার টোল দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ছবি- সংগৃহীত

বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার কৃষক এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা একই কৃষিপণ্যের ওপর বারবার টোল দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদ- এই তিন স্তর থেকে পৃথকভাবে টোল আদায় করা হচ্ছে। এতে ব্যাপক ক্ষতি ও লোকসানের মুখে পড়ছেন তারা।

স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মাঠে ঘাম ঝড়িয়ে ফসল ফলানোর পর তা বাজার পর্যন্ত নিয়ে যেতে প্রতিটি ধাপে তাদের আলাদাভাবে টোল গুণতে হচ্ছে। প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদের টোল, পরে উপজেলা বা পৌরসভার এবং সবশেষে জেলার বাইরে পণ্য পাঠালে জেলা পরিষদের টোল দিতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি কমছে কৃষকের লাভ।

লামা উপজেলার রূপসীপাড়ার কৃষক ওসমান গনি জানান, একটি পণ্যের ওপর বারবার টোল দিতে গিয়ে লাভের মুখ তো দেখিই না, উল্টা যা ছিল তাও যাচ্ছে। কলা, কাঁঠাল, মরিচ, এমনকি গরুর ওপরেও টোল আদায় করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কৃষকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, লামা পৌরসভার বিভিন্ন সড়ক পথে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির সময় এবং পৌর এলাকায় উৎপাদিত পণ্য রপ্তানির ওপর টোল আদায় করা হয়। লামা বাজার নদীঘাটের লাইনঝিরি পয়েন্টে এক ছড়া কলায় ৫ টাকা, প্রতি শত লেবুতে ৫ টাকা, প্রতিটি কাঁঠালে ৩ টাকা এবং প্রতি মণ তুলায় ৫৫ টাকাসহ বিভিন্ন পণ্যে টোল আদায় করা হচ্ছে।

এদিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদম উপজেলা পরিষদের রেপারপাড়া বাজারস্থ টোল পয়েন্টে বিভিন্ন কৃষিপণ্যের ওপরও টোল আদায় করা হচ্ছে। সেখানে এক ছড়া কলায় ৫ টাকা, প্রতি কাঁঠালে ৫ টাকা, একটি পাহাড়ি গরুতে ৫০০ টাকা, প্রতি মণ কাঁচা মরিচে ১৫ টাকা, প্রতি মণ ধানে ২০ টাকা এবং প্রতি শত আঁখে ২০০ টাকা করে টোল আদায় করা হয়।

আলীকদম উপজেলার চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের ব্যবসায়ী বদিউল আলম বলেন, ইউনিয়নে টোল দিয়ে উপজেলা গেট পার হতে গিয়েও আবার টোল দিতে হয়। এরপর যদি বাইরে পাঠাই, সেখানেও জেলা পরিষদের টোল। তিন জায়গায় তিন দফা টোল-এটা আসলে জুলুম।

তাদের দাবি, কৃষিপণ্য পরিবহনে এই অতিরিক্ত আর্থিক চাপ উৎপাদনকারীদের নিরুৎসাহিত করছে।

কৃষক মো. জসীম বলেন, একটু লাভের আশায় আমরা কাজ করি, কিন্তু এই টোলনির্ভর শোষণ তো আমাদের শেষ করে দিচ্ছে।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্বত্য তিন জেলার জেলা পরিষদগুলোকে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ওপর টোল আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়। সেই সময় পৌর এলাকার মধ্যে টোল ও ইজারার আয় বণ্টনের হিস্যাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

পৌর এলাকার মধ্যে জেলা পরিষদের বাজার ফান্ড পায় ৪০%, পৌরসভা কর্তৃপক্ষ পায় ৪০% এবং উপজেলা পরিষদ পায় ২০%। আর পৌর এলাকার বাইরে জেলা পরিষদ পায় ৫৫% এবং উপজেলা পরিষদ পায় ৪৫%।

তবে একাধিক স্তরে টোল আদায়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। বিষয়টি জেলা পরিষদের নজরে এলে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক থানজামা লুসাই চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল একটি স্মারকের মাধ্যমে আলীকদম উপজেলা পরিষদের টোল আদায় বন্ধের নির্দেশ দেন।

নির্দেশনায় বলা হয়, স্থানীয় সরকার বিভাগে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তিন পার্বত্য জেলার ইজারালব্ধ আয় ও টোল হতে প্রাপ্ত আয়ের হিস্যা জেলা পরিষদ, বাজার ফান্ড, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে বণ্টন হয়ে থাকে। তিন পার্বত্য জেলার পৌর এলাকার বাইরে টোল থেকে প্রাপ্ত আয়ে ১০ শতাংশ পায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। অবশিষ্ট ৯০ শতাংশকে ১০০ শতাংশ ধরে জেলা পরিষদ ৫৫ শতাংশ এবং উপজেলা পরিষদ ৪৫ শতাংশ হারে অর্থ বণ্টনের নির্দেশনা রয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও আলীকদম উপজেলা পরিষদ কর্তৃক টোল আদায়ের বিষয়টি বোধগম্য নয়। এতে স্থানীয় জনসাধারণ হয়রানির শিকার হচ্ছে। চলমান দ্বৈত টোল পরিশোধ হতে স্থানীয় জনসাধারণকে পরিত্রাণ প্রদানের লক্ষ্যে এবং স্থানীয় টোল পরিশোধ নিশ্চিতকরণের জন্য আলীকদম উপজেলা পরিষদ কর্তৃক টোল পয়েন্ট থেকে টোল আদায় বন্ধসহ টোল পয়েন্টটি অপসারণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

তবে ওই নির্দেশনা জারির পরও আগের মতোই চলছে টোল আদায়। কৃষিপ্রধান একটি অঞ্চলে কৃষকদের ওপর এভাবে টোলের চাপ দেওয়াকে ‘অযৌক্তিক ও অমানবিক’ বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয়রা বলছেন, দ্রুত একটি সমন্বিত নীতিমালার মাধ্যমে একদফা ও যৌক্তিক হারে টোল নির্ধারণ না করলে কৃষিকাজে আগ্রহ হারাবেন কৃষক।

আলীকদম উপজেলার বাসিন্দা বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সাইফুল ইসলামের সঙ্গে টোল আদায়ের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নোটিশ জারির পরও আলীকদমে টোল আদায় বন্ধ ও টোল পয়েন্ট অপসারণ করেননি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।

বিষয়টি নিয়ে আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা পরিষদের প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল মুমিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে, তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।