ঢাকা সোমবার, ১১ আগস্ট, ২০২৫

বরিশালে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল
প্রকাশিত: আগস্ট ১১, ২০২৫, ১২:০৬ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

বরিশালে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। বিশেষ করে শহরের অভ্যন্তরের কয়েকটি কলোনিতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাদক বেচাকেনা নগরবাসীর মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকের এই ভয়াল থাবা থেকে স্থানীয় যুবসমাজকে রক্ষা করাসহ বিক্রেতাদের টুটি চেপে ধরতে চাইলেও অদৃশ্য কারণে সফল হতে পারছে না। 

তবে সময় বিশেষে ২/৪ জনকে মাদকের বড় চালানসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করলেও কিছুদিন পরে আইনের ফাঁক গলে তারা বেরিয়ে আসছেন এবং ফের মাদক ক্রয়-বিক্রয়ে সক্রিয় হয়ে পড়ছেন। অপ্রতিরোধ্য মাদকের এই বাণিজ্যে খোদ মাঠপুলিশের অসাধু কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিকদের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণও মিলছে।

অভিযোগ আছে, বরিশাল শহরের কেডিসি, ভাটারখাল, রসুলপুর, মোহাম্মদপুর, পলাশপুরসহ আলেকান্দা রিফিউজি কলোনিতে (বস্তি) প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের বাজার বসছে। এই সময়ে কলোনিতে বিভিন্ন মাধ্যমে গাঁজা এবং ইয়াবার বড় বড় চালান ঢুকছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিছুটা নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগটি লুফে নেয় মাদক বিক্রেতারা। জনশ্রুতি রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগে বাণিজ্য করে বরিশাল শহরের অন্তত ১০ মাদক বিক্রেতা কোটিপতি বনে গেছেন। সেই সঙ্গে অর্থবিত্তে লালে লাল হয়েছেন তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা কজন রাজনৈতিক নেতা।

শহরের ভাটারখাল এলাকার চিহ্নিত মাদক বিক্রেতা মুন্না এবং জুথি আক্তার—তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী। এই দম্পতি আওয়ামী লীগের শাসনামলের বড় একটা সময় কীর্তনখোলা নদীতীর ঘেঁষা শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রসুলপুর কলোনিতে মাদক বাণিজ্য করেছেন। মাদকসংক্রান্ত তাদের বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। কিন্তু তারপরও তাদের বাণিজ্য রোধ করা সম্ভব হয়নি। গোয়েন্দা পুলিশের একটি টিম সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসের শেষের দিকে এই দম্পতিকে শহরের ভাটারখাল কলোনি থেকে গাঁজার একটি বড় চালানসহ গ্রেপ্তার করে।

সূত্র জানিয়েছে, রসুলপুরের বাসিন্দা জুথি-মুন্না আওয়ামী লীগের শাসনামলে বরিশাল নৌবন্দর এলাকায় মাদকের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলেন। পথশিশুদের ব্যবহার করে তারা বাণিজ্য চালাতেন। এ নিয়ে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় একাধিকবার সংবাদ প্রকাশ পেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বেশ কয়েকবার পাকড়াও করে। 

কিন্তু বেশিদিন আটকে রাখা সম্ভব হয়নি—আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে এসে ফের শুরু করেন নেশার ব্যবসা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের বাইরে থাকতে কৌশল হিসেবে স্থান বদল করে বসবাস শুরু করেন শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের কালিজিরা এলাকায়।

সূত্রটি জানিয়েছে, জুথি-মুন্না কালিজিরায় বসবাস করলেও বরিশাল নদীবন্দরে তাদের মাদকের বেচাকেনা চলত। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতন হলে পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকার সুযোগে এই দম্পতি শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটারখাল কলোনিতে অবস্থান নেন। 

রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা সেখানে বসবাসের পাশাপাশি গোটা কলোনি এবং নদীবন্দর এলাকা মাদকে সয়লাব করে ফেলেন। গত ২১ জুলাই ডিবি পুলিশ তিন কেজি গাঁজার চালানসহ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠালেও তাদের মাদক বাণিজ্য অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।

রসুলপুরের আরেক বড় মাদক বিক্রেতা লিপি-পলাশ দম্পতির বিরুদ্ধেও অর্ধ ডজনের বেশি মাদক মামলা আদালতে চলমান রয়েছে। সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্টের পরে নৌপথ ব্যবহার করে তারা অসংখ্য ইয়াবা ও গাঁজার চালান নিয়ে এসেছেন। 

আওয়ামী লীগের শাসনামলে কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের একটি টিম তাদের ২৫ কেজি গাঁজাসহ গ্রেপ্তার করার নজিরও রয়েছে। কিন্তু তাদেরও দীর্ঘদিন কারান্তরীণ রাখা সম্ভব হয়নি; জামিনে মুক্ত হয়ে পূর্বের সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের রাসেল মেম্বর মাদক বেচাকেনা এবং প্রশাসনিক ঝামেলা এড়িয়ে চলার ক্ষেত্রে কয়েক ধাপ এগিয়ে। ত্রিশোর্ধ্ব এই যুবক গোটা আশ্রায়ন প্রকল্পকে মাদকের ঘাঁটিতে রূপ দিয়েছেন। বাসা থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দূরে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে ২৪ ঘণ্টা মনিটরিং করাসহ মাদক বিক্রি করছেন। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ধরতে অগ্রসর হলে তিনি একটি ট্রলার নিয়ে সোজা নদীপথ পাড়ি দিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধেও একাধিক মাদক মামলা রয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এ ছাড়া শহরের আলেকান্দা রিফিউজি কলোনির বাসিন্দা রফিকও মাদক বাণিজ্য করে ধনকুবের বনে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকসহ তাকে একাধিকবার গ্রেপ্তার করলেও তার বেচাকেনা রোধ করা যায়নি। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এই মাদক বিক্রেতার বিরুদ্ধে পুলিশকে মারধর করে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তিনি শহরের সি অ্যান্ড বি রোড কাজীপাড়া এলাকাতেও মাদকের বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

মাদকের এই ভয়াবহ ছোবল থেকে যুবসমাজকে রক্ষায় শুক্রবার কাউনিয়া থানাধীন শহরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রোকেয়া আজিম রোডে মানববন্ধন হয়েছে। এতে স্থানীয় হাজার হাজার নারী-পুরুষ অংশ নেন এবং মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। 

এলাকার একাধিক বাসিন্দা অভিযোগ করেন, স্থানীয় সাহেবের পুকুরপাড়ের বাসিন্দা মামুন, রাজন এবং রিমনসহ অন্তত ১০ জনের বেশি যুবক মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের বিক্রিত মাদকে শহরের উত্তরাঞ্চলের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, অধিকাংশ ছেলেপান সারাদিন নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শুক্রবার বিকেলে মানববন্ধন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

শহরের অধিকাংশ কলোনিতে মাদকের ব্যাপক বিস্তার থাকলেও পুলিশের তৎপরতায় ১০ নম্বর ওয়ার্ডের আলোচিত কেডিসি বস্তির বেচাকেনা কিছুটা হলেও কমেছে। এই কলোনিতে চলতি বছরে মাদকের ক্রয়-বিক্রয় উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যায়, যা নিয়ে বরিশালের সুশীল সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু এরপরও মাদকের ওপেন বেচাকেনা বন্ধ করা যাচ্ছিল না।

তবে কলোনির হর্তাকর্তা আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল আবেদীন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পরে মাদক বিক্রি কিছুটা কমেছে বলে জানা গেছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কলোনিতে অন্তত অর্ধশত মাদক বিক্রেতা রয়েছেন, যারা প্রত্যেকে সাবেক কাউন্সিলর জয়নালকে মাসোহারা দিয়ে বাণিজ্য করতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি মাদক ব্যবসার অনুমতি দিয়ে অর্থ নিতেন। এ নিয়ে একাধিকবার পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলেও প্রভাবশালী জয়নালকে থামানো যায়নি।

জানা গেছে, এই কলোনির মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গে মাঠপুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার গোপন যোগসাজশ রয়েছে। আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আগাম খবর মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকার পরামর্শ দেন। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ১৩ জুলাই মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের কনস্টেবল ফারুক হোসেনকে শাস্তিমূলক প্রত্যাহার করা হয়।

মাদকের বিষে নীল হয়ে যাওয়া আলোচিত কেডিসি কলোনিকে মাদকমুক্ত করতে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রশাসন একধরনের ‘জেহাদ’ ঘোষণা করেছে। এখানকার কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর বাসা উচ্ছেদ করাসহ এই মরণনেশা বিক্রি বন্ধে স্থানীয়দের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা সার্বক্ষণিক কলোনিতে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন এবং প্রশাসনকে তথ্য দিয়ে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে সহযোগিতা করবেন। 

বরিশাল পুলিশের এই উদ্যোগকে সুশীল সমাজ সাধুবাদ জানিয়েছেন। শুধু কেডিসি নয়, গোটা শহরকে মাদকমুক্ত করতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

তাদের ভাষায়, মাদকের ভয়াবহতা এতটাই প্রকট যে পুরুষের পাশাপাশি নারী আসক্তের সংখ্যাও ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নারীদেরও তাদের পরিবার নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা দিতে বাধ্য হচ্ছে।

শহরের রূপাতলীর ড্রিম লাইফ মাদকাসক্তি ও মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালক নাজমুল হাসান বাপ্পি জানান, শুধু তার প্রতিষ্ঠানেই বর্তমানে ১৪ নারী চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। গত সাত দিনে নতুন ভর্তি হয়েছেন ৪ নারী, যারা সকলে ইয়াবায় আসক্ত।

বরিশালের মতো শহরে মাদকাসক্ত হয়ে নারী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নেওয়া প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পরিতোষ কুমার কুণ্ডু। তিনি বলেন, তাদের মাঠকর্মীরা নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে, এতে বিক্রেতাদের গ্রেপ্তারসহ মাদকও উদ্ধার হচ্ছে। তবে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

২০২৩ সালের শেষের দিকে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ক) সার্কেলের উপপরিদর্শক মো. ওবায়দুল্লাহ এবং সিপাহি সবুর শহরের মোহাম্মদপুরে মাদক বিক্রেতাদের কাছে গাঁজা সরবরাহ করতে গিয়ে জনতার হাতে আটক হন। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী তাদের একচোট দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন; পরবর্তীতে তারা মাদক মামলায় কারান্তরীণও ছিলেন।

বরিশাল শহরসহ আশপাশের এলাকাসমূহে যে মাদকের ব্যাপক বিস্তার রয়েছে এবং তা গ্রহণে স্থানীয় যুবসমাজ ধ্বংসের পথে অগ্রসর হচ্ছে—তা খোদ বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলামও স্বীকার করেছেন। 

তার ভাষায়, কিছুদিন পূর্বে মাদকসংক্রান্ত দুটি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে মাঠপুলিশকে কাজ করার কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—বরিশাল শহরকে যে কোনো মূল্যে মাদকমুক্ত করতে হবে।