২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। তখন রাজধানী ঢাকায় চলছিল সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলন। সেই আন্দোলনে অংশ নেন ভোলার লালমোহনের মো. মাছুম বিল্লাহ (২৮)। তার লক্ষ্য ছিল যেকোনো মূল্যে সরকারের পতন ঘটানো।
তবে আন্দোলনে যোগদানের মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই পুলিশের ছোড়া প্রায় চার শ ছররা গুলি তার শরীরের বাম পা থেকে শুরু করে কাঁধ পর্যন্ত বিদ্ধ হয়। এরপর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
পরে সঙ্গে থাকা আন্দোলনকারীরা তাকে উদ্ধার করে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু সে সময়ের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেখানেও কোনো চিকিৎসা পাননি মাছুম বিল্লাহ।
একটিমাত্র ইনজেকশন নিয়েই ফিরতে হয় তাকে। শরীরের ভেতর থেকে বের করা সম্ভব হয়নি অধিকাংশ গুলি। এখন সেই গুলির তীব্র যন্ত্রণায় দিন কাটছে তার।
ভোলার লালমোহন উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জনতা বাজার এলাকার মহির উদ্দিন হাওলাদার বাড়ির সন্তান মাছুম বিল্লাহ। তার বাবা মো. মাকসুদুর রহমান সেন্টু।
আন্দোলনে আহত যুবক মাছুম বিল্লাহ জানান, তিন বছর আগে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসায় অনার্সে ভর্তি হন। পাশাপাশি কামারাঙ্গিরচরে কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি হাফেজি মাদ্রাসা চালু করেন। সেই মাদ্রাসা আর পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটছিল। তবে আন্দোলন শুরু হলে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে আন্দোলনটি গড়ায় সরকার পতনের দাবিতে। ওই আন্দোলন দমাতে আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং পুলিশ নির্বিচারে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাতে থাকে।’
‘প্রাণ যায় অনেকের। আমিও নিজেকে আর থামাতে পারিনি। ৫ আগস্ট সকাল ৮টায় আজিমপুর থেকে আন্দোলনে যোগ দিই। কিন্তু মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে ছররা গুলিতে আমার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।’
মাছুম আরও বলেন, ‘অজ্ঞান হয়ে পড়লে আমাকে অন্য আন্দোলনকারীরা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে পরদিন আবার আত্মীয়-স্বজনদের সহায়তায় নেওয়া হয়। তখন কেবল ৪-৫টি গুলিই শরীর থেকে বের করা যায়।’
‘এরপর ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হসপিটালে গিয়ে কিছু গুলি বের করা হয়। সবশেষে যাই সিএমএইচ-এ। এতসব হাসপাতালে চিকিৎসার পরও এখনো শরীরের বামপাশের পা থেকে কাঁধ পর্যন্ত অন্তত সাড়ে তিন শ গুলি রয়ে গেছে।’
বর্তমানে মাছুম বিল্লাহ প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘সিএমএইচ-এর চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন ব্যথার ওষুধ খেয়ে থাকতে হবে। আমার তো কোনো আয় নেই। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বাবা জীবিত আছেন বলেই কোনোরকমে সংসার চলছে। তিনিই বা আর কতদিন চালাবেন?’ তারও তো অন্যান্য সন্তান আছে।’
‘আমার স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে একটি চাকরি করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভালোভাবে বাঁচব। কিন্তু এখন তো নিজের বাঁচাটাই অনিশ্চিত। আমি সরকারের কাছে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি আমার স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি।’
তার বাবা মো. মাকসুদুর রহমান সেন্টু বলেন, ‘আমার পাঁচ ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেকে ভালো করে মানুষ করতে ঢাকায় পড়তে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে আন্দোলনে অংশ নিয়ে আজ এ অবস্থা। যদিও সরকারিভাবে দুই লাখ টাকা এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছি, কিন্তু আমি নিজে আরও চার লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘জমিও বিক্রি করতে হয়েছে। এখনো আমার ছেলের শরীরে গুলি রয়েছে। সেই যন্ত্রণায় সে ছটফট করে। ব্যথার ওষুধ খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছে। আমি আর কতদিন তার পরিবার চালাব? আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, আমার ছেলের উন্নত চিকিৎসা ও তার পরিবারটির ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হোক।’
এ বিষয়ে লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহ আজিজ বলেন, ‘আন্দোলনে যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন, তাদের জন্য সরকারি বরাদ্দ এরই মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও যদি কোনো সরকারি সহায়তা আসে, সেটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :