যশোরের দুঃখ হিসেবে পরিচিত ভবদহ এলাকায় আবারও ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। টানা বৃষ্টির পানি গ্রামকে গ্রাম প্লাবিত করে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ২১ ভেন্টের স্লুইসগেটের মাত্র ৬টি কপাট খোলা থাকায় পানি নিষ্কাশনে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, পানি নিষ্কাশনের জন্য একের পর এক প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও বাস্তবে তেমন কোনো সুফল মেলেনি। বছরের পর বছর জলাবদ্ধতার সঙ্গে লড়াই করে এখন তারা চরমভাবে ক্লান্ত। এই অবস্থার অবসানে তারা টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) চালুর দাবি জানিয়েছেন।
জলাবদ্ধতা ভবদহ অঞ্চলের মানুষের জন্য এক অভিশাপে পরিণত হয়েছে। বর্ষা এলেই দুর্ভোগ বাড়ে। এবারের টানা বৃষ্টিতে ভবদহের ৫২টি বিল প্লাবিত হয়েছে, এরই মধ্যে ৪৫টি গ্রামে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
জানা গেছে, ১৯৬০ সালের দিকে যশোর সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর ও অভয়নগর উপজেলা এবং খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহে শ্রীনদীর ওপর নির্মাণ করা হয় ২১ ভেন্টের স্লুইসগেট। গেটটি শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী নদীসহ যশোর ও খুলনার মোট ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশনের জন্য নির্মিত হয়। কিন্তু অধিকাংশ সময় কপাট বন্ধ থাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
১৯৯৪ সালে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার পর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় নেওয়া হয় ভবদহ পানি নিষ্কাশন প্রকল্প (কেজিডিআরপি)। এতে ব্যয় হয় ২৫৭ কোটি টাকা। পরে ২০০৭ সালে আরও ৫৯ কোটি ৫৯ লাখ এবং ২০১০ সালে ৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। এছাড়া একাধিক ছোট প্রকল্পে ব্যাপক ব্যয় হলেও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি।
স্থানীয়দের মতে, ভবদহ অঞ্চলে পানি ওঠানামা করে মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীর মাধ্যমে। কিন্তু পলি পড়ে এসব নদী এখন নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে পানি বের হতে পারছে না। জলাবদ্ধতা রোধে এখন টিআরএম প্রকল্পের বাস্তবায়ন জরুরি।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি জানিয়েছে, মনিরামপুর উপজেলার কুলটিয়া ইউনিয়নের ১৪টি, চলিশা ইউনিয়নের ৫টি, সুন্দলী ইউনিয়নের ১০টি, পায়রা ইউনিয়নের ৫টি, হোগলাডাঙ্গা ইউনিয়নের ৮টি এবং নেহালপুর ইউনিয়নের ৩টি- মোট ৪৫টি গ্রাম ইতিমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অভয়নগরের কোটা, চলিশিয়া, বাগদাহ, আন্ধা, বলারাবাদ, বেতভীটা, সরখোলা, ডুমুরতলা, সুন্দলী, ডহর মশিয়াহাটী, বাড়েধা, দীঘলিয়া, ভাটাডাঙ্গী ও বারান্দি- এসব গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন।
এছাড়াও ভেসে গেছে শত শত মাছের ঘের, শত শত হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। বাড়ির উঠানে কোমরসমান পানি জমে আছে। মানুষ ও গবাদিপশু একই ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও হাঁটু পানি।
ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের দিলীপ বিশ্বাস বলেন, ‘উঠানে বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছি। পানি আরেকটু বাড়লেই ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়বে।’
শুসান্ত ও শ্যামল বিশ্বাস জানান, ‘ভবদহের জলাবদ্ধতা আমাদের জীবনের বড় দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় থাকা প্রায় অসম্ভব।’
ভবদহ সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রনজিত বাওয়ালি জানান, ‘সরকার আমডাঙ্গা খাল সংস্কার, ৮১ কিলোমিটার নদী খনন এবং টিআরএম প্রকল্প হাতে নিলেও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বিপর্যয় বাড়ছে। সুইচগেটের ২১টি ভেন্টের মধ্যে মাত্র ৬টি খোলা। সবগুলো কপাট খুললে পানি দ্রুত বেরিয়ে যাবে।’
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘ভবদহে ৬টি কপাট চালু রয়েছে। স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে চীনা বিশেষজ্ঞ দল এলাকা পরিদর্শন করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগোচ্ছে।’
যশোর জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার ভবদহ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আন্তরিক। পানিবন্দি মানুষের কষ্ট লাঘবে সব ধরনের চেষ্টা চলছে।’
আপনার মতামত লিখুন :