রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


শেখ সেকেন্দার আলী, পাইকগাছা

প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২৪, ১২:২৮ পিএম

বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য ঢেঁকি

শেখ সেকেন্দার আলী, পাইকগাছা

প্রকাশিত: অক্টোবর ৭, ২০২৪, ১২:২৮ পিএম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

খুলনার পাইকগাছায় গ্ৰাম বাংলার ঐতিহ্য ধান ভাঙ্গা ঢেঁকি বিলুপ্ত হচ্ছে। আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে ঢেঁকির বিলুপ্ত হচ্ছে গ্রাম বাংলায়।

ও বউ ধান ভানেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া, ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া দুলিয়া ও বউ ধান ভানেরে...........। গ্রাম বাংলার মহিলাদের কন্ঠে আগে প্রায়ই শোনা যেত এ ধরনের সুর আর ঢেঁকির ঢিপ ঢিপ শব্দ। ঢেঁকিতে উঠে কত গান ও কত প্রবাদ গাওয়া হতো গ্রাম্য মেয়েদের। ঐতিহ্যবাহী সেই ঢেঁকি আজ বিলুপ্তির খাতায়। সময় আর জীবন দুটিই বহমান শিবসা নদীর মতো। জোয়ারে এক রকম আর ভাটায় ভিন্ন রকমের পরিবেশ মুহূর্তেই যেন পাল্টে যায় চিত্র।

খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় এক সময় ঢেঁকি দিয়ে চাল তৈরি, চিড়া ভাঙা, আটা, গম, জব, পায়েসের চালের গুঁড়ো, খির তৈরির চাল বানানোর সেই ঢেঁকি-আজ অসহায় হয়ে পড়েছে ইঞ্জিনচালিত মেশিনের কাছে।

বর্তমান যান্ত্রিকতার যুগে এই চির চেনা সুর যেন প্রায়ই হারিয়ে গেছে। কালের বিবর্তনে প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে পাইকগাছা থেকে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প। এক সময় জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রায় সকল বাড়ীতে ছিল ঢেঁকি। কিন্তু এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। গ্রামের অভাবগ্রস্থ গরিব অসহায় মহিলাদের উপার্জনের প্রধান উপকরণ ছিল ঢেঁকি। গ্রামের বিত্তশালীদের বাড়ীতে যখন নতুন ধান উঠতো তখন অসহায় অভাবগ্রস্থ মহিলারা ঢেঁকিতে ধান ছেঁটে চাউল বানিয়ে দিতো। তা থেকে তারা যা পেতো তা দিয়েই ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার চলে যেতো। ঢেঁকিতে ধান ভানতে গিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের হাসি-তামাশার কথা বলতো ও গান গাইতো। কিন্তু ৮০ দশক হতে খুলনার দক্ষিণ অঞ্চল পাইকগাছার আবাদি জমিতে ধানের পরিবর্তে চিংড়ি মাছের চাষ আসায় ঢেঁকির ব্যবহার হারিয়ে যেতে থাকে। কোন আবাদি জমিতে আর ধান চাষ হয় না। সে ক্ষেত্রে ধান মাড়াই করার কোন সুযোগ নেই। অল্পকিছু জমিতে ধান চাষ হলেও সেটা মাড়াই হয় মেশিনে। আর বিত্তশালীরা তাদের জমি চিংড়ি চাষীদের নিকট টাকার বিনিময়ে হারীতে দিয়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছে। 

অতীতে গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে ঢেঁকি ঐতিহ্য বহন করতো। তাল বা অন্য গাছের গুড়ার উপর লম্বা কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরী হত ঢেঁকী। শক্ত ধরনের প্রশস্ত গাছ কেটে সটান আকৃতি করে ঢেঁকি তৈরি করা হয়। এর মাথার দিকটা মোটা। আর পিছনের দিকটা চেপ্টা। মাথার দিকে থাকে একটি শুড়। একে বলে মুষল। মুষলের শেষ প্রান্তে লাগানো থাকে লোহার আংটা। কেউবা কাঠ দিয়ে, কেউবা সিমেন্ট দিয়ে আংটা ও মুষল পড়ার জায়গা তৈরি করে। একে বলে নোট। এই নোটের মধ্যেই ফেলানো হয় ধান। ঢেঁকির পেছনের দিকে লাখি দিয়ে সামনের মাথা উচু হয়ে ধানের উপর পড়তে থাকে। এর পরেই ক্রমাগত পাড় দিতে দিতে ধান ভানা হয়ে যায়। গ্রামের ফাঁকা স্থানে বা কোন রকম ছাউনি দিয়ে বাড়ীর এক পাশে তৈরী করা হতো ঢেঁকি ঘর। শীত মৌসুমে ধান ভাঙার পাশাপাশি ঠিকরে কলাই বড়ি বানাতে ঢেঁকি ব্যবহার হতো। সন্ধ্যা হতে গভীর রাত পর্যন্ত অথবা খুব ভোরে উঠে মহিলারা ঢেঁকিতে পাড় দিত। সকালের ঘুম ভাঙতো তখন ঢেঁকির ক্যাচ-কুচ, ডুক-ঢাক শব্দে। ঢেঁকি দিয়ে ধান ভাঙতে সর্বনিম্ন দুই জন মহিলা হলে চলতো। কেউ পাড় দেয়, কেউ এলে দেয়। এভাবেই চলে ধান ভানার কাজ। বাড়িতে অতিথি এলে ঢেঁকিতে ধান কুটার তোড়জোড় শুরু হতো। এই নিয়মে চিড়ে, ছাতু তৈরি করা হতো। তারপর গভীর রাত অবধি চলতো রকমারী পিঠা-পায়েস বানানো আর সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে খাওয়ার আমেজটা ছিল খুবই উপভোগ্য। 

ঢেঁকি ছাটা চালের ভাত, পেলাও, জাউ আর ফিরনী ছিল অত্যান্ত সুস্বাদু। ঢেঁকিতে কোটা চিড়া আর চালের গুড়ির পিঠার কোন জুড়ি ছিলনা। এসব খাদ্যের সুবাতাস কয়েক বাড়ী পর্যন্ত পৌছে যেত। সে কথা মনে হলে এখন খাওয়ার জন্য মনটা পাগল হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ঢেঁকিছাটা চালে প্রচুর ভিটামিন রয়েছে বলে চিকিৎসাবিদরা রুগীকে ঢেঁকি ছাটা চাউলের ভাত খেতে বলতো।

কিন্তু কালের বিবর্তনে আমরা সবই হারাতে বসেছি। আর এখন পিঠা বানানোর অন্যতম উপকরণ চালের গুড়ো বানাতে দু’এক গ্রাম খুঁজলেও ঢেঁকির দেখা মেলা না। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে এখন ঢেঁকি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। কয়েক বছর আগেও গ্রাম-গঞ্জের বিত্তবানসহ প্রত্যেক বাড়ীতে দেখা যেত ঢেঁকি। এখন ঢেঁকির পরিবর্তে আধুনিক ধান ভাঙ্গার রাইচ মিলে চাল কোটার কাজ চলছে। পাইকগাছার যে সব গ্রামে বিদ্যুত পৌছায়নি সেখানে ডিজেলের মেশিন ছাড়াও ভ্যান গাড়িতে শ্যালো ইঞ্জিন নিয়ে বাড়ীতে বাড়ীতে যেয়ে ধান মাড়াই করেন। যার কারনে গ্রামের অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মহিলারা যারা ধান ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা বিকল্প পথ বেছে নেওয়া ছাড়া অনেকে ভিক্ষা করে দিন অতিবাহিত করছে।

পাইকগাছার খড়িয়া গ্রামের সন্ধ্যা রানী (৪০) লতিকা (৪০), মনিরা বেগম (২৮), লাভলি আক্তার (৪০), তপতী (৪২) এ রকম অনেকে জানান, ঢেঁকিতে ভাঙা চাউলের গুড়ার পিটা-পায়েস স্বাধ ছিল অতুলনীয়। ঢেঁকির অভাবে অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও পিঠা তৈরী করে খাওয়া হয় না। তাছাড়া এখন আর কারোর বাড়ীতে ঢেঁকি পাওয়া যায় না।”ঢেকির ঢেক ঢেকানি আর শোনা যায়না। শুধু পাইকগাছা নয় জেলার প্রায় সকল অঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি শিল্প। তাইতো কবির ভাষায় বলি-“তব রাজপথে চলিছে মোটর সাগরে জাহাজ চলেরে রেলপথে চলে রেল ইঞ্জিন দেশ ছেয়ে গেছে কলে।”

পাইকগাছার গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা সকল আবাদি জমিতে চিংড়ি চাষের পাশাপাশি ধান চাষের জন্য স্থানীয় জন প্রতিনিধি সহ প্রশাসনের কাছে জোর দাবী জানিয়েছেন, যেন তারা ধান চাষের মাধ্যমে প্রাচীন কালের ঐতিহ্য ঢেঁকি শিল্প ফিরিয়ে আনতে পারে।

আরবি/জেডআর

Shera Lather
Link copied!