লক্ষ্মীপুরে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার ব্যাটারিচালিত মিশুক, অটোরিকশা ও ইজিবাইক চলাচল করছে। প্রতিটি অটোরিকশার ব্যাটারিতে প্রতি চার্জে সর্বোচ্চ ২ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। অধিকাংশ অটোরিকশার ব্যাটারি দিনে দুইবার চার্জ দিতে হয়। ফলে প্রতিদিন এসব যানবাহনের ব্যাটারি চার্জ দিতেই প্রায় ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে।
কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, একটি অটোরিকশারও নিবন্ধন নেই এবং চালকদের কেউই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। এখনো পর্যন্ত কোনো প্রশাসনিক দপ্তর থেকে অটোরিকশা নিবন্ধন বা চালক প্রশিক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এদিকে অপ্রশিক্ষিত চালকদের কারণে শহরে প্রায়ই তীব্র যানজট দেখা দেয়, ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা। যান্ত্রিক ত্রুটি বা সমস্যা সম্পর্কে চালকদের ধারণা না থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়েছে। সচেতন মহলের দাবি, এসব অটোরিকশার প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ চালক মাদক ও জুয়ার সঙ্গে জড়িত। তারা কিছু টাকা উপার্জন করলেই মাদক সেবন বা জুয়ায় লিপ্ত হন। প্রশিক্ষণহীনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত।
লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডে অন্তত ৭ হাজার অটোরিকশা চলাচল করছে। শুধু শহরের উত্তর তেমুহনী থেকে দক্ষিণ তেমুহনী পর্যন্ত এক কিলোমিটার রাস্তায় প্রতিদিন প্রায় এক হাজার অটোরিকশা দেখা যায়। যানজটের কারণে এই রাস্তা পার হতে যেখানে সময় লাগা উচিত ৫ মিনিট, সেখানে প্রায় আধাঘণ্টা সময় লাগে।
অন্যদিকে বেপরোয়া গতিতে চলা এসব অটোরিকশার কারণে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। পথচারী, যাত্রী এমনকি চালকরাও আহত হচ্ছেন। কখনো কখনো ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ব্যাটারির সংযোগ খুলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান আসমা বেগম (২৮)। তার দুদিন আগে ১৩ ডিসেম্বর রামগতিতে ট্রাককে ধাক্কা দিয়ে নিহত হন যাত্রী নাছিমা আক্তার (২৫)। তারও ৫ দিন আগে ৮ নভেম্বর পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে অটোরিকশা চালক আবু তাহের (৫০) নিহত হন। এ ছাড়া ৬ ডিসেম্বর ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান চালক সোহেল (৩২)।
একই বছরের ২৯ মার্চ হাসপাতালে যাওয়ার পথে বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে জুথি আক্তার (২০) ও তার দেড় বছরের সন্তান সিয়াম নিহত হন। এ ছাড়া ২০ জানুয়ারি অটোরিকশার দুর্ঘটনায় মুরাদ ও আনোয়ার নিহত হন।
অটোরিকশা চালক আবদুর রশিদ, আবদুল মান্নান, ফারুক হোসেন ও আবদুর রহিম মুন্সি জানান, তারা প্রায় ৮ বছর ধরে ভাড়ায় অটোরিকশা চালাচ্ছেন। তবে শহরে দিন দিন অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে চলায় রাস্তায় ভিড় বাড়ছে। বাজারে একবার যেতেই দীর্ঘ সময় আটকা থাকতে হয়। তারা জানান, বিদ্যুতের বিল দিয়েই ব্যাটারি চার্জ দেন।
জেলা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. হারুন বলেন, ‘আমাদের প্রায় ৩ হাজার সদস্য রয়েছে এবং তাদের কাছে প্রায় ৬ হাজার দুই-যাত্রী ধারণক্ষম অটোরিকশা আছে। প্রতিটি ব্যাটারিতে প্রতি চার্জে প্রায় ৪০ টাকা খরচ হয়। নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও লক্ষ্মীপুর জেলায় মোট প্রায় ৩০ হাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা রয়েছে।’
লক্ষ্মীপুর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) প্রশান্ত মজুমদার বলেন, ‘অটোরিকশা চালকদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তাদের বেপরোয়া আচরণের কারণেই রাস্তায় বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা যানজট নিরসনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রশিক্ষণ ও নিবন্ধন না থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।’
লক্ষ্মীপুর পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ ফারাভি জানান, অটোরিকশার কোনো নিবন্ধন নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে আমরা তা বাস্তবায়ন করব।
লক্ষ্মীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার শফিউল আলম বলেন, ‘আমাদের আওতাধীন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ গ্রাহক রয়েছে। রাতে ১২০ মেগাওয়াট ও দিনে প্রায় ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। কিছু এলাকায় লোডশেডিং হয়। আবাসিক সংযোগে ব্যক্তিগতভাবে এক-দুইটি অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার অনুমতি আছে, তবে বেশি চার্জ দিতে হলে আলাদা অনুমোদন নিতে হয়। তবে এমন সংযোগের সঠিক সংখ্যা আমাদের জানা নেই।’
লক্ষ্মীপুর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল আমিন জানান, ‘আমাদের আওতাধীন প্রায় ৪৩ হাজার গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে আনুমানিক ১৫০ থেকে ২০০টি সংযোগে অটোরিকশার চার্জ দেওয়া হয়। প্রতিদিন এসব সংযোগে দেড় থেকে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। বর্তমানে আমাদের প্রায় ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে।’



