মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীতে তরা ব্রিজ ও জনবসতির মাত্র একশো মিটারের মধ্যে আটটি ভারী খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। এতে বাড়িঘর যেমন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে, তেমনি ঝুঁকিতে পড়েছে ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের তরা সেতু। চোখের সামনে ভিটেমাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, অথচ দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কিছুই করার নেই।
হরিরামপুরের ধুলশুরা গ্রামের আনোয়ারা বেগমের বয়স সত্তরের বেশি। স্বামী সামাদ তালুকদার মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। একমাত্র ছেলেকে নিয়েই তার সংসার। একসময় বিপুল ভূসম্পত্তির মালিক থাকলেও পদ্মার ভাঙনে ছয়বার বসতভিটা হারিয়ে তরা এলাকায় আশ্রয় নেন তিনি।
সেখানে ১৪ শতক জমি কিনে বাড়ি তুলেছিলেন। এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র এক শতাংশ। কালীগঙ্গার ভাঙনে সেই ভিটেটুকুও যে কোনো সময় নদীর পেটে চলে যেতে পারে। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, নদীর ধারে বসে আনোয়ারা বেগম খননযন্ত্রে বালু তোলা দেখছেন অপলক দৃষ্টিতে। চোখে জল, কণ্ঠে হাহাকার- ‘শেষ সম্বলটুকুও কি আর থাকবে না?’
তরা ব্রিজ থেকে সোহাগ টিম্বার হয়ে রমজান আলী হাই স্কুল পর্যন্ত ৫০-৬০টি বাড়ি রয়েছে ভাঙনের হুমকিতে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। রান্নাঘর, টয়লেট নদীতে চলে গেছে, টিকে আছে শুধু শোবার ঘর।
৮০ বছর বয়সী হামেলা বেগমের ১১ শতাংশ জমি থেকে এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র দুই শতাংশ। লালু বিশ্বাস ও কাইয়ুম মৃধার ৩২ শতাংশ জমি থেকে কেবল শোবার ঘরটুকুই বেঁচে আছে। নুরুল ইসলামের ২২ শতাংশ জমির মধ্যে আছে মাত্র তিন শতাংশ।
রমজান আলী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও মসজিদও ঝুঁকিতে রয়েছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক নৃত্যানন্দ বসাক বলেন, ‘স্কুলের সীমানার খুব কাছাকাছি বালু তোলা হচ্ছে। ভাঙনের ঝুঁকির পাশাপাশি ড্রেজারের শব্দে পড়াশোনায়ও ব্যাঘাত ঘটছে।’
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফ হোসেন বলেন, ‘বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হবে। এমনকি বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মানববন্ধন করা হবে। এভাবে বালু উত্তোলন করা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। কাজেই বিদ্যালয় রক্ষা করতে হলে অবাধে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।’
হামেলা বেগমের নাতি রাজিব বলেন, ‘দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা বালু তোলা হচ্ছে। দিনে বাড়ির দুইশো ফুট দূর থেকে বালু তোলা হয়, আর রাতে বাড়ির সীমানা ঘেঁষে বালু তোলা হয়। প্রতিবাদ করলে আমাদের কথা কেউ শোনে না। আওয়ামী লীগের আমলে বালু উত্তোলনের প্রতিবাদ করায় মামলা দিয়ে আমাদের হয়রানি করা হয়েছে। এখনও হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’
লালু বিশ্বাসের স্ত্রী পারুল বেগম বলেন, ‘চোখের সামনে ভিটেমাটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। কখন যেন শোবার ঘরটাও নদীতে চলে যায়। এরপর আমরা কোথায় যামু?’
সরেজমিনে দেখা গেছে, কালীগঙ্গার তরা ব্রিজ ও জনবসতির মাত্র একশো মিটারের মধ্যে আটটি ভারী খননযন্ত্র দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। ভাঙনের কবলে পড়েছে নদীতীরবর্তী বেশ কয়েকটি বাড়িঘর। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে আরও অর্ধশতাধিক বাড়িঘর। ফলে আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় দিন পার করছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
মানিকগঞ্জে মোট সাতটি বালুমহাল রয়েছে। চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল জেলা প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি দেয় এবং ৮ মে সর্বোচ্চ দরদাতাকে ইজারা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঘিওরের তরা বালুমহালটি ৭ কোটি ৫১ লাখ ৯৯ হাজার ৯০০ টাকায় ইজারা পান মেসার্স রিজু এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. কামাল হোসেন।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী—বসতবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্রিজ বা সেতুর এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ। নদীর তীর থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে ড্রেজার বসানো যাবে না। একই সঙ্গে একাধিক খননযন্ত্র দিয়ে বালু উত্তোলন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানিকগঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কালীগঙ্গা নদীটি সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লী এলাকার ধলেশ্বরী নদী থেকে উৎপত্তি হয়ে সদর ও ঘিওর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শিবালয়ের ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে শেষ হয়েছে। ৭৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটির প্রস্থ ২৪২ মিটার। নদীটির আশেপাশে ঘন জনবসতি, বিদ্যালয়, সেতু ও বাঁধ রয়েছে। তাই আইন অনুযায়ী এই নদীর মূল প্রবাহে (বিশেষত জনবসতির কাছাকাছি অংশে) বালুমহাল ইজারা দেওয়া যাবে না।
কালীগঙ্গা নদীর প্রস্থ যেহেতু ২৪২ মিটার, এবং আইন অনুযায়ী নদীর এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই, সুতরাং বালুমহাল ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। এমনকি ইজারাদার কিংবা প্রশাসন আইনের এসব শর্ত আমলেই নিচ্ছেন না।
মেসার্স রিজু এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘সীমানার বাইরে আমার একটি কাটারও নেই। থাকলে আমি জরিমানা দিতে বাধ্য হবো। এটা নিয়ে গত তিন-চার দিন ধরে ডিসি অফিসের সঙ্গে দফায় দফায় কথা হয়েছে। আমি বলেছি, আপনারা লোক পাঠিয়ে দেখেন, সীমানার বাইরে বালু উত্তোলন করলে ধরে নিয়ে যান।’
মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘বালুমহালের সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। নিয়ম অমান্য করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’