‘ইতিহাস একদিনে হারিয়ে যায় না, যদি আমরা তাকে ধরে রাখি। আর অবহেলা করলে- সে নিশ্চুপ হয়ে যায়।’ এই কথাগুলো যেন হুবহু মিলে যায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির বর্তমান চিত্রের সঙ্গে। বাইরে সামান্য রঙের চাকচিক্য, অথচ ভেতরে এক নির্মম অবহেলায় ধ্বংসের মুখে শত বছরের প্রাচীন এ স্থাপনাটি।
নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে সবুজ-শ্যামল পরিবেশে অবস্থিত মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ি কেবল একটি স্থাপনা নয়, এটি এই অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক।
১৮৮৯ সালে নাটোরের রাজপরিবারের বিশ্বস্ত কর্মচারী রামরতন ব্যানার্জী মুড়াপাড়ায় জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তার পুত্র বিজয় চন্দ্র ব্যানার্জী জমিদারির পরিধি বাড়িয়ে তোলেন। আর তারই বড় ছেলে জগদীশ চন্দ্র ব্যানার্জী ১৯০৯ সালে রাজকীয় এই জমিদার বাড়ির নির্মাণ সম্পন্ন করেন।
প্রায় ৪০ একর জমির ওপর নির্মিত এই রাজবাড়ীতে ছিল ৯৫টি কক্ষ, যার মধ্যে ছিল- জমিদারি কার্যক্রমের অফিস, পূজার মন্দির, অতিথিশালা, বৈঠকখানা, নাচঘর, কাচারিঘর প্রভৃতি।
সামনের দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদী ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। পুরো এলাকা ঘিরে ছিল আমবাগান, ঝাউবন, পুকুরঘাটসহ একটি সুশৃঙ্খল সৌন্দর্যমণ্ডিত পরিবেশ।
অথচ সেই রাজবাড়ীর অবস্থা এখন করুণ। ছাদে ফাটল, দেয়ালে ধস, জানালায় ভাঙা কাঠ, প্রতিটি কক্ষেই গাছের শিকড় প্রবেশ করেছে। ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা গাছ আর ঝুলে থাকা শিকড় যেন ইতিহাসের হাহাকার।
১৯৮৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে এটি সরকারি মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও কোনো রকম রক্ষণাবেক্ষণ নেই।
কলেজের অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান জানান, ‘সংস্কারের জন্য বহুবার চিঠি দিয়েছি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। কিছু শ্রেণিকক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বন্ধ করতে হয়েছে। তবে যেহেতু এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে, তাই সরাসরি সংস্কার করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
তিনি আরও জানান, ‘পাশেই আটতলা নতুন ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। সেটি শেষ হলে কলেজ কার্যক্রম সেখানে স্থানান্তর করা হবে এবং ঐতিহাসিক ভবনটিকে সংরক্ষণের সুযোগ তৈরি হবে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, ‘বাইরের দেয়াল রং করে সাজানো হলেও ভেতরের অবস্থা ভয়াবহ। নেই পর্যটন কেন্দ্র, নেই সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ।’
তাদের মতে, মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িকে কেন্দ্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা গেলে স্থানীয় অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার হতে পারত।
রূপগঞ্জবাসী ও ইতিহাসপ্রেমীদের আহ্বান, ‘মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দ্রুত পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এটি কেবল একটি ভবন নয়, বরং বাংলার জমিদারি ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।’