নাটোরের লালপুরে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ‘অতি দরিদ্র মহিলা ভাতা’ (ভিডব্লিউবি) কর্মসূচির ২০২৫-২৬ অর্থবছরের উপকারভোগী তালিকা নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রকাশিত তালিকায় দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত দরিদ্র ও অসহায় মহিলাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিত্তবান স্ত্রী ও স্বজনদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রশাসনের ওয়েবসাইট ও ইউনিয়ন পর্যায়ে টানানো তালিকা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, তালিকাভুক্ত অন্তত ৬০ শতাংশ মহিলাদের দরিদ্রতার কোনো প্রমাণ নেই। বরং তাদের পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, কারও কারও রয়েছে দুইতলা বাড়ি, জমিজমা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অথচ এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে স্বামী-নিহত, স্বামী-পরিত্যক্ত, অসচ্ছল, কর্মক্ষমহীন ও খাদ্যনিরাপত্তাহীন মহিলাদের সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া।
আড়বাব ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও বিএনপি নেতা শাহিনুল ইসলামের স্ত্রী আয়েশা আক্তার, লালপুর সদর ইউনিয়নের ছাত্রলীগ নেতা রায়হান আলীর স্ত্রী মিম খাতুন, বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের ইউপি সদস্য রফিকুল মালিথার স্ত্রী ফাইমা খাতুন এবং বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এখলাসুজ্জামান জুম্মার স্ত্রী শ্যামলী বেগম—তালিকায় উঠে আসা এসব নাম সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
বিশেষ করে রায়হান আলীর স্ত্রীর নাম তালিকায় থাকার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ আরও তীব্র হয়েছে। কারণ এলাকাবাসী জানায়—রায়হান আলীর দুইতলা বাড়ি রয়েছে, তিনি ব্যবসায় সফল এবং কোনোভাবেই ‘অতি দরিদ্র’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত না। কিন্তু এরপরও তার স্ত্রীকে ভাতার আওতায় আনা হয়েছে, যা প্রকৃত দরিদ্রদের প্রতি চরম অবিচার।
এমন চিত্র শুধু একটি ইউনিয়নে নয়, বরং পুরো উপজেলার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নেই কমবেশি একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। কদিমচিলান ও ওয়ালিয়া ইউনিয়নেও বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজনরা নাম পেয়েছেন এই তালিকায়। অথচ দরিদ্র, স্বামীহীন, শারীরিকভাবে অক্ষম বা নিঃস্ব বহু নারী এখনো তালিকার বাইরে রয়েছেন।
এ বিষয়ে বিএনপি নেতা শাহিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ইউনিয়নে মাত্র পাঁচটি কার্ড পেয়েছি। দরিদ্র অনেকেই বাদ পড়েছে। আমি চালের কার্ডটা স্ত্রীর নামে করে নিয়েছি, যেন চাল এনে গরিবদের মধ্যে ভাগ করে দিতে পারি।’
তবে এমন বক্তব্যে স্থানীয়দের সন্তুষ্ট করতে পারেননি। একজন প্রবীণ বাসিন্দা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কার্ডের মাধ্যমে চাল আনিয়ে গরিবদের বিলি করার দায়িত্ব কীভাবে একজন বিত্তবান পরিবারের ওপর দেওয়া হয়? তাহলে তো এটাই প্রমাণ করে যে প্রকৃত দরিদ্রদেরই স্থান নেই এই প্রকল্পে!’
এদিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৪ জুলাই ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত তালিকাটি উপজেলার অফিস প্রাঙ্গণে টানানো এবং সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। কারও যদি এ নিয়ে আপত্তি থাকে, তাহলে আগামী ২৪ জুলাই (বুধবার)-এর মধ্যে লিখিত অভিযোগ ইউএনও বরাবর জমা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
‘অতি দরিদ্র মহিলা ভাতা’ কর্মসূচি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। এর মাধ্যমে বাস্তবিক অর্থে অসচ্ছল, অসহায়, বিধবা ও প্রতিবন্ধী নারীদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাদ্যশস্য অথবা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু তালিকায় বিত্তবানদের অন্তর্ভুক্তি ও প্রকৃত দরিদ্রদের বঞ্চিত করার এই চিত্র প্রকল্পটির উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যে যেভাবে পারছে নিজের আত্মীয়কে সুবিধাভোগীর তালিকায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর এই অনিয়মের বলি হচ্ছেন তারা, যারা প্রকৃত অর্থেই সহায়তার যোগ্য।
স্থানীয় এক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘রাজনীতির রঙ যদি গরিবের ভাতার ওপর ছায়া ফেলে দেয়, তাহলে এই দেশ থেকে সামাজিক নিরাপত্তা বলতে কিছু থাকবে না। এই অনিয়ম বন্ধ করতে না পারলে প্রকল্পের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে।’
এ বিষয়ে লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি। বিত্তবান যেই হোক, তার নাম বাতিল করা হবে। প্রকৃত দরিদ্ররা যেন বঞ্চিত না হন, সেদিকে কড়া নজর রেখেছি।’

 
                             
                                    


 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                    -20251031233315.webp) 
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                    -20251031164732.webp) 
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন