উত্তরের দারিদ্র্যপীড়িত জেলা রংপুর। এই জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের শ্যামপুর চিনিকল একসময় দেশের অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই চিনিকল শুরুর পর থেকেই এলাকার কৃষক, শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ মানুষের জীবনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। হাজারো মানুষের মুখে ফিরেছিল খুশির হাসি। আখ চাষের জন্য এই অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছিল ব্যাপক সমৃদ্ধি। এতে ৭ হাজারেরও বেশি শ্রমিক-কর্মচারী ও প্রান্তিক আখচাষির ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে।
কিন্তু ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর আচমকা মিলটি বন্ধ ঘোষণা করা হলে পুরো এলাকা থমকে যায়। ভূতুড়ে এক জনপদে পরিণত হয় মিল চত্বর। চিনিকল এলাকা অন্ধকারে ঢেকে যায়। কৃষিশ্রমিকেরা কাজ হারান। বিপাকে পড়েন শত শত কর্মচারী ও প্রান্তিক আখচাষি। অবশেষে চার বছর পর সেই জট খুলল। গত ১৭ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শ্যামপুর চিনিকল পুনরায় চালু করার ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণায় আশার আলো দেখছেন কর্মরত কর্মচারী ও স্থানীয় আখচাষি, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ।
এদিকে গত চার বছর বন্ধ থাকায় ৩৫ একর আয়তনের এই চিনিকলের চত্বর ভরে গেছে জঙ্গলে। খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা আখ পরিবহনের যানবাহনগুলোও ধ্বংসের পথে। কারখানার ভেতরের দৃশ্যটাও একই রকম। কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতিতে এখন মরিচার রাজত্ব। থমকে আছে জীবিকার চাকাগুলো।
আখচাষি আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিত্যদিনের সমাবেশের চিরচেনা দৃশ্য নেই। হাজারো মানুষের একসময়ের জীবন-জীবিকার কেন্দ্রস্থলের প্রবেশপথ ও মিলে আখ সরবরাহের জন্য শত শত সারিবদ্ধ গাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণ এখন গোচারণভূমি।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহুকুমার গোবিন্দগঞ্জ থানার মহিমাগঞ্জে শুরু হয় রংপুর চিনিকলের নির্মাণকাজ। ২৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছর পর শেষ হয় মিলটির নির্মাণকাজ। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুম থেকেই আখ মাড়াইয়ের মাধ্যমে চিনি উৎপাদন শুরু হয় মিলটিতে। ১৯৭২ সালে রংপুর চিনিকলসহ সব চিনিকলকে রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই চিনিকলের কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। পুকুরসহ রেলওয়ে সাইডিংয়ের জায়গা ৮ একর, সাড়ে ১৪ একর জায়গায় গড়ে ওঠে ৫০টি ইক্ষু ক্রয়কেন্দ্র এবং আটটি সাবজোন।
এ ছাড়া মিলের নিজস্ব খামারের জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮৩২ একর। ১৯৫৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৩ বছরে ২২ হাজার ৯৮৫ দিনের মধ্যে ৫ হাজার ৭৩৯ দিন ঘোরে মিলের চাকা। এই সময়কালে ৫৬ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে উৎপাদন করা হয় ৪ লাখ ২৭ হাজার মেট্রিক টন চিনি।
গত ১৫ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আফরোজা বেগম পারুলের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীন মাড়াই স্থগিত করা চিনিকলসমূহে পুনরায় মাড়াই কার্যক্রম চালু করা হবে। 
মাড়াই স্থগিত করা চিনিকলসমূহ পুনরায় চালু করার জন্য এবং চিনিকল লাভজনকভাবে চালানোর নিমিত্তে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রণয়নের লক্ষ্যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ওই টাস্কফোর্সের সুপারিশ ও মতামতের আলোকে চলতি মাসের ৩ তারিখে পর্যাপ্ত আখ পাওয়া সাপেক্ষে প্রথম পর্যায়ে শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল, দ্বিতীয় পর্যায়ে পঞ্চগড় ও পাবনা চিনিকল, তৃতীয় পর্যায়ে কুষ্টিয়া ও রংপুর চিনিকলের মাড়াই কার্যক্রম পুনরায় চালু করার লক্ষ্যে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘোষণার পর শ্যামপুর চিনিকলটির আশপাশের এলাকার আখচাষি, শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে খুশির জোয়ার বইছে। আখ চাষে আগ্রহ বৃদ্ধি ও মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এমন আশায় স্বপ্ন দেখছেন ওই এলাকার মানুষ।
এর অগে ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন দেশের শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড় ও রংপুর চিনিকলের আখ মাড়াইয়ের কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেয়।
কিন্তু সুগার মিল চালুর ঘোষণা এলেও চাষিদের শঙ্কা কাটছে না। কারণ চার বছর ধরে মিলটি বন্ধ থাকায় আখচাষিরা অন্য ফসল চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। কারণ একই জমিতে আখ চাষ করলে ১৭ মাস সময় লাগে। তত দিনে ওই জমিতে তিন থেকে চারটি ফসল চাষ করা সম্ভব। এ কারণে এখন আখ চাষ নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয় আখচাষি সমিতির নেতারা।
মিল সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্যামপুর সুগারমিলটি শুরুতে ছিল রংপুরের একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ১১১ একর জমিতে গড়ে ওঠা এই চিনিকলে প্রথমে ১০ হাজার ১৬০ মেট্রিকটন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এলাকায় চিনি উৎপাদন বৃদ্ধি, আখ চাষে উৎসাহ এবং কৃষকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এটি উত্তর জনপদের রংপুর অঞ্চলের এক বড় অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা আর্থিক সমস্যা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় চিনিকলটির মুখ থুবড়ে পড়ে। ১৯৮৫ সালের পর থেকে একে একে লোকশান শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বরে বন্ধ হওয়ার সময় পর্যন্ত শ্যামপুর সুগার মিলে লোকশানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২২৬ কোটি টাকা। মিল বন্ধের ফলে প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী, খণ্ডকালীন কর্মচারী ও আখচাষি বেকার হয়ে পড়েন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়ে আছে আখ পরিবহনের ট্রাক্টরগুলো। যন্ত্রপাতি মরিচায় নষ্ট হচ্ছে। ভূতুড়ে এলাকায় পড়ে আছে গোটা মিল চত্বর। শেড ঘরের টিনের চালা ফুটো। জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ে জরাজীর্ণ পুরো মিল এলাকা। বকেয়া বেতন-ভাতা না পেয়ে শ্রমিকেরা দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তবে মিল চালুর ঘোষণায় পাওনা টাকা পাওয়ার আশায় উৎসাহ-উদ্দীপনায় আশার আলো দেখছেন তারা।
এদিকে সংশ্লিষ্ট মিল কর্মকর্তারা জানান, শ্যামপুর চিনিকল পুনরায় চালু করার পর প্রথম যে কাজটি করতে হবে, তা হলো মিলের অবকাঠামোগত সংস্কার। ২০২০ সালে মিল বন্ধ হওয়ার পর যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য জিনিসপত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যন্ত্রপাতির অনেক অংশ অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকায় নষ্ট হয়েছে, যা পুনরায় কার্যকর করতে হলে নির্দিষ্ট অর্থের প্রয়োজন হবে।
আখচাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, হঠকারী সিদ্ধান্তে মিল বন্ধ করায় আখচাষিরা অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকেছেন। সময়মতো চাষিদের উৎসাহ দিয়ে আখ রোপণ এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে মিল সংস্কার করা দরকার।
শ্যামপুর চিনিকল আখচাষি কল্যাণ কমিটির সাবেক সাধারণ স¤পাদক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘১২০ দিন মিল চালানোর জন্য আখের মজুত থাকা দরকার হয়। সে হিসাবে অন্তত ৬ থেকে ৭ হাজার একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। মিল চালুর ঘোষণায় এলাকার মানুষ আনন্দিত ও উজ্জীবিত। এ জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।’
শ্যামপুর সুগার মিল এমপ্লোয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান বলেন, মিল চালুর ঘোষণায় আমরা অনেক খুশি। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে আখ রোপণ, মিল সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে শ্যামপুর থেকে বদলি হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ এলাকায় ফেরত আনা প্রয়োজন। কারণ তারা কৃষকদের বেশি উৎসাহ দিয়ে আখ চাষে আগ্রহী করতে পারবে। বেশি দেরি হলে আখ না থাকার অজুহাতে মিলটি যথাসময়ে চালু করা সম্ভব হবে না।
কৃষকদের দাবি, সরকার আখ চাষে প্রচুর প্রণোদনা দিলেই সম্ভব হবে বন্ধ হওয়া চিনিকলগুলোর ঘুরে দাঁড়ানো। আর যেন কোনো অদৃশ্য কারণে বন্ধ না হয় শ্যামপুর চিনিকল।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                    -20251031233315.webp) 
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                    -20251031164732.webp) 
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন