শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীর পুঠিয়া, চারঘাট ও দুর্গাপুর উপজেলায় শুরু হয়েছে খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির ব্যস্ততা। প্রতিদিন ভোরে গ্রামীণ জনপদে গাছিদের রস সংগ্রহের দৃশ্য যেন শীতের পরিচিত চিত্র হয়ে উঠেছে। ঘরে ঘরে চলছে খাঁটি খেজুরের গুড় তৈরির প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে বাজারে উঠতে শুরু করেছে খুরি, পাটালি ও ঝোলা গুড়, যার ঘ্রাণে মুগ্ধ হচ্ছেন ক্রেতারা।
তবে এবার এই চিরচেনা মৌসুমী চিত্রের মধ্যে দেখা দিচ্ছে উদ্বেগজনক দিক। বাজারে খাঁটি গুড়ের পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়েছে ভেজাল গুড়। অসাধু কিছু ব্যবসায়ী খরচ কমাতে গুড়ে চিনি মিশিয়ে উৎপাদন করছেন, যা স্বাদ ও মান, দুটোতেই প্রতারণা।
স্থানীয় হাট-বাজারে দেখা গেছে, অনেক ক্রেতাই বুঝতে না পেরে ভেজাল গুড় কিনছেন। অপরদিকে, খাঁটি গুড় উৎপাদনকারী প্রকৃত গাছিরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। খাঁটি গুড় তৈরিতে যেখানে মণপ্রতি খরচ পড়ে প্রায় ৫ হাজার টাকা, সেখানে ভেজাল গুড় কম খরচে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে চাষি ও ভোক্তারা দুজনই ক্ষতিগ্রস্ত।

সচেতন মহল ও ভোক্তারা প্রশাসনের কাছে ভেজাল প্রতিরোধে নিয়মিত বাজার মনিটরিং ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন, যাতে করে ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড়ের মান বজায় থাকে এবং প্রকৃত উৎপাদকরা ন্যায্য দাম পান।
স্থানীয় কৃষক জুয়েল ইসলাম জানান, “এক মণ খাঁটি গুড় বানাতে প্রায় ৫২০০ টাকা খরচ হয়। কিন্তু বাজারে চিনি মিশ্রিত ভেজাল গুড় কম দামে বিক্রি হওয়ায় আমাদের খাঁটি গুড়ের দাম উঠছে না। ফলে এবছর আমরা লোকসানে পড়তে যাচ্ছি।”
তথ্য অনুযায়ী, যেখানে খাঁটি গুড়ের প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা, সেখানে চিনি মেশানো ভেজাল গুড় ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম কম হওয়ায় অনেক ভোক্তা ভেজাল গুড়ের দিকে ঝুঁকছেন।
গাছিরা অভিযোগ করছেন, কিছু অসাধু ব্যক্তি চিনি ও রাসায়নিক মিশিয়ে গুড় তৈরি করছেন, যা দেখতে ভালো হলেও স্বাদ, গুণমান ও স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতিকর। খাঁটি গুড় তৈরিতে সময়, শ্রম ও খরচ বেশি হওয়ায় এর দাম বেশি হয়। কিন্তু ভেজাল গুড় সস্তায় বিক্রি হওয়ায় প্রকৃত চাষিরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
চাষিরা বলছেন, বাজার থেকে ভেজাল গুড় বন্ধ না হলে খাঁটি গুড় উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন তারা, যা একদিকে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি জনগণের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়াবে। ভোক্তাদের পাশাপাশি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা জানান, বাজারে কঠোর নজরদারি ও নিয়মিত অভিযান না হলে এই শিল্প বিলুপ্তির পথে যাবে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী রাজু বলেন, “বাজারের ১০০% গুড়ে চিনি মেশানো হয়। চিনি না দিলে গুড়ের কালারও ভালো হয় না।” ভোক্তাদের অনেকেই জানেন না কোনটা খাঁটি আর কোনটা ভেজাল। ফলে চিনি মিশ্রিত গুড় সহজেই বাজারে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
পুঠিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. সুচনা জানান, “চিনি মিশ্রিত গুড় খেলে দাঁতে ব্যাকটেরিয়া বাড়ে, ক্যাভিটি তৈরি হয়, হজমে সমস্যা দেখা দেয়, ওজন বাড়ে এবং ডায়াবেটিস ও লিভারের জটিলতা তৈরি হতে পারে।”
ভোক্তাদের দাবি, প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারি এবং ভেজাল উৎপাদকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বাজারে খাঁটি গুড়ের নিরাপদ সরবরাহ নিশ্চিত করা হোক। ভুক্তভোগী চাষিরা আশা করছেন, শীত যত বাড়বে সচেতন ভোক্তারা খাঁটি গুড় চিহ্নিত করতে শিখবেন এবং প্রকৃত পণ্যের যথাযথ মূল্য দেবেন। এতে খেজুর রস ও গুড়কে ঘিরে ঐতিহ্যবাহী কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি সুরক্ষিত থাকবে।


সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন