ঢাকা শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

রাষ্ট্র নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ হলে ন্যায়ের জন্য লড়াই অপরিহার্য: প্রধান বিচারপতি

রাবি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২৫, ০৬:৪১ পিএম
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করা অপরিহার্য—এমন মন্তব্য করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আইন কেবল নিয়মের সমষ্টি নয়; এটি জাতির নৈতিক বিবেকের প্রতিফলন। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র দৃঢ় হয়, আর ন্যায় ব্যর্থ হলে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রও ভেঙে পড়ে। যখন রাষ্ট্র নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাদের কণ্ঠরোধ করে, তখন ন্যায়ের জন্য লড়াই করা নৈতিকভাবে অপরিহার্য হয়ে ওঠে।’

শনিবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে তিনি এ কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি। সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি এস. এম. এমদাদুল হক ও বিচারপতি এ. কে. এম. আসাদুজ্জামান।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সকলকে উপলব্ধি করতে হবে যে, তারা একটি পারস্পরিক দায়বদ্ধতার সম্পর্কে দায়বদ্ধ। তাদের সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে সহযোগিতা, যুক্তিবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীলতা। এখানে কোনো ধরনের অবিশ্বাস গত ১৫ মাসের নিরলস প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারে। বিচারবিভাগীয় স্বায়ত্তশাসনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকল অংশগ্রহণকারীর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমন্বয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার জন্য ছিল না। এটি ছিল ন্যায়, মর্যাদা ও অস্তিত্বের অধিকারের সংগ্রাম। ঠিক একইভাবে ১৯৭১ সালে বাঙালি কেবল একটি পতাকা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য নয়; বরং মর্যাদা, সমতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য স্বাধীনতার সংগ্রামে নিয়োজিত হয়েছিল।’

বিচার বিভাগ সংস্কারের প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রশাসনিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ, নৈতিকভাবে সাহসী ও সংবিধানিকভাবে শক্তিশালী বিচার বিভাগ গঠন করতে হবে।’ তিনি বিচার বিভাগ সংস্কারের একটি ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করেন। এর কেন্দ্রে রয়েছে একটি পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। এই সচিবালয় বিচার প্রশাসনের কেন্দ্রীয় কাঠামো হিসেবে কাজ করবে, যেখানে ন্যায়বিচার ও সাধারণ মানুষের বিচার ব্যবস্থায় অভিগম্যতা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশের নীতিগত অনুমোদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫, বিগত ১৫ মাসের সুপরিকল্পিত কৌশলগত প্রচেষ্টা ও বহুপাক্ষিক প্রয়াসের ফল। এই ১৫ মাসে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাহী শাখার মধ্যে কৌশলগত বোঝাপড়া ও সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। এখন আমাদের প্রয়োজন পারস্পরিক সহযোগিতা, আস্থা ও দূরদর্শিতা; যাতে বিচার বিভাগের কাঠামোগত স্বাধীনতা দীর্ঘস্থায়ী হয়।’

কাঠামোগত এই পরিবর্তনের টেকসই রূপায়ন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট অংশগ্রহণকারীর প্রতি আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতি। এর জন্য তিনি জেলা আদালতের আইনজীবী সমাজ, সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন, জেলা আদালতের বিচারকবৃন্দ, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনসহ সকল অংশগ্রহণকারীর প্রতি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান।

আইন সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আইনের অধ্যয়ন কেবল পেশাগত প্রশিক্ষণ নয়; এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সাধনা। প্রত্যেক আইনজীবী ও বিচারককে মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেক আইনের পেছনে আছে একটি জীবন, প্রত্যেক রায়ের পেছনে আছে একটি ভাগ্য। ন্যায়ের প্রকৃত মান নিরপেক্ষ ও মানবিক বিচারের মধ্যে নিহিত।’

প্রযুক্তি-নির্ভর ন্যায়বিচার ব্যবস্থার গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো ঔপনিবেশিক কাঠামোর উত্তরাধিকার বহন করছি। তাই ডেটা-নির্ভর ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল সংযোগ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্বয়ংক্রিয়তার যুগে আমাদের বিচারব্যবস্থাও সময়োপযোগী হতে হবে।’

দেশের আইনাঙ্গনের সমৃদ্ধিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য প্রাজ্ঞ আইনবিদ তৈরি করেছে। আমি বিশ্বাস করি, এখান থেকে ভবিষ্যতেও এমন আইনজ্ঞ তৈরি হবে, যারা কেবল জ্ঞানে নয়, মানবিকতাতেও আলোকিত হবে।’

বক্তব্যের সমাপ্তিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ন্যায়বিচারের পুনর্জাগরণ এখন আমাদের সময়ের আহ্বান। সংবিধানের যে স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার রয়েছে, তা যেন দেশের প্রতিটি নাগরিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়, সেটিই আমাদের দায়িত্ব।’

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট বিভাগের ৩২ জন বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, শিক্ষক, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তাবৃন্দ, বিশিষ্ট আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও নবীন আইন স্নাতকসহ বিভাগের সাবেক ও বর্তমান তিন সহস্রাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।