দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতিকে নাড়া দেওয়া প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা মার্সেল ওফুলস মারা গেছেন। শনিবার ৯৭ বছর বয়সে মারা যান এই অস্কারজয়ী পরিচালক।
তার মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করেছেন নাতি আন্দ্রেয়াস-বেঞ্জামিন সাইফার্ট জানিয়েছেন, ‘তিনি শান্তিতে মারা গেছেন।’
জার্মান-ফরাসি বংশোদ্ভূত ওফুলস নিজের জীবনেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন নাৎসি শাসনের ভয়াবহতা। ১৯২৭ সালের ১ নভেম্বর ফ্রাঙ্কফুর্টে জন্ম নেওয়া মার্সেল ছিলেন কিংবদন্তি পরিচালক ম্যাক্স ওফুলস ও অভিনেত্রী হিলদে ভাল-এর সন্তান।
নাৎসিদের উত্থানের কারণে মাত্র ছয় বছর বয়সেই তার পরিবারকে পালাতে হয়। ফ্রান্সে আশ্রয় নিলেও সেখান থেকেও ১৯৪০ সালে নাৎসিদের আগ্রাসনের মুখে পালিয়ে তারা স্পেন হয়ে পৌঁছান যুক্তরাষ্ট্রে।
পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষে ১৯৪৬ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর থিয়েটার ইউনিটে কাজ করেন জাপানে। এরপর ১৯৫০ সালে ফিরে আসেন ফ্রান্সে। শুরু করেন চলচ্চিত্রে কাজ- জুলিয়েন ডুভিভিয়ে ও আনাতোল লিটভাকের সহকারী হিসেবে।
১৯৬৪ সালে ‘বানানা পিল’ নামের একটি কৌতুক-রহস্যধর্মী কাহিনি ছবিতে সাড়া ফেলেন। তবে শিগগিরই মন দেন ডকুমেন্টারিতে।
তার সবচেয়ে আলোচিত কাজ ১৯৬৯ সালের চার ঘণ্টার প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য সরো অ্যান্ড দ্য পিটি’। ক্লেরমঁ-ফেরঁ শহরকে কেন্দ্র করে তৈরি এই ডকুমেন্টারিতে ওফুলস ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনের গ্লোরিফায়েড মিথ ভেঙে দেন।

ফরাসিদের প্রতিরোধের গর্বিত বর্ণনার বিপরীতে তিনি দেখান- সহযোগিতার ছায়া ছড়িয়ে ছিল সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনদের মধ্যেও। ফলাফল ফরাসি জাতীয় আত্মপরিচয়ে আঘাত লাগায়- ফরাসি টেলিভিশনে ছবিটি নিষিদ্ধ থাকে দীর্ঘ এক দশক, সম্প্রচার হয় ১৯৮১ সালে।
এই ছবির নাম উঠে আসে ‘অ্যানি হল’র মতো হলিউড ক্লাসিকেও। সেখানে প্রথম ডেট হিসেবে ‘দ্য সরো অ্যান্ড দ্য পিটি’ দেখানোর প্রসঙ্গ এনে ছবির প্রভাবকে পপ সংস্কৃতিতে তুলে ধরেন উডি অ্যালেন।
এরপর ওফুলস বানান ‘হোটেল টারমিনাস : দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অব ক্লস বারবি’, নাৎসি যুদ্ধাপরাধী ‘লিওনের কসাই’ খ্যাত ক্লস বারবির জীবনের ওপর নির্মিত চাঞ্চল্যকর তথ্যচিত্র, যার জন্য তিনি ১৯৮৮ সালে অস্কার জিতেছিলেন সেরা ডকুমেন্টারি বিভাগে।
জীবনের শেষ দিকে ওফুলস মুখ খোলেন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট নিয়েও। ২০১৪ সালে শুরু করেন ‘আনপ্লেজান্ট ট্রুথস’ নামে একটি ডকুমেন্টারি প্রজেক্ট, ইসরায়েলি নির্মাতা ইয়ায়াল সিভানের সঙ্গে মিলে।
ছবিতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও রাজনৈতিক দখলদারত্বের বিষয়টি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তারা। ছবির প্রাথমিক পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন ফরাসি নিউ ওয়েভ পরিচালক জঁ লুক গদারও, যিনি পরবর্তীকালে সরে গেলেও ছবিতে এক ঝলক দেখা যায় তাকে। তবে আর্থিক ও আইনি জটিলতায় ছবি আর শেষ করা যায়নি।
স্মৃতির ভেতর থাকা অস্বস্তিকর সত্যগুলো অন্বেষণই ছিল মার্সেল ওফুলসের কাজের কেন্দ্রবিন্দু। ইতিহাসকে প্রশ্ন করেই নির্মাণ করতেন তিনি। মৃত্যুর পরও তার রেখে যাওয়া ডকুমেন্টারিগুলো আমাদের বারবার সেই প্রশ্নে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :