বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের প্রবাদপ্রতীম নায়ক, সুরের সওদাগর, ছয় তারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু আজও কোটি ভক্তের হৃদয়ে অমর। জীবদ্দশায় অসংখ্য গান, গিটার আর কনসার্টে মাতিয়ে রেখেছেন তিনি। কিন্তু আলোর পেছনে ছিল অসংখ্য অজানা গল্প, ছিল সংগ্রাম, অভিমান আর সাফল্যের মাইলফলক। আজ কিংবদন্তীর জন্মদিনে চলুন জেনে নিই এমনই অজানা পাঁচটি গল্প।
১. ৬০০ টাকা নিয়ে স্বপ্নের পথে
শৈশব থেকেই সংগীতপ্রেমী আইয়ুব বাচ্চুর পরিবার চেয়েছিল তাকে পড়াশোনা শেষে ব্যবসায় যুক্ত করতে। কিন্তু বোহেমিয়ান মনের এই তরুণ তা মানেননি। ১৯৮৩ সালে মাত্র ৬০০ টাকা হাতে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন তিনি।
রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের এক হোটেলে থাকতেন, সঙ্গে ছিল শুধু একটি গিটার। সেই গিটার আর অদম্য অনুশীলনই তাকে বানিয়েছিল দেশের ব্যান্ডসংগীতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী তারকা। শ্রোতাদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ‘গিটারের জাদুকর’ আর সহশিল্পীদের কাছে এক অনন্য ‘বস’।
২. রাত আড়াইটায় হঠাৎ পপগুরুর ডাক
এক গভীর রাতে হঠাৎ ফোন পেলেন ‘পপ গুরু’ আজম খানের কাছ থেকে। রাত আড়াইটায় গুরুর ডাক অমান্য করেননি তিনি। বাইকে চড়ে পৌঁছে যান কমলাপুরের এজিবি কলোনিতে, যেখানে হাজারো মানুষ মগ্ন ছিলেন আজম খানের গানে।
মঞ্চে উঠেই গুরু তাকে স্নেহে জড়িয়ে ধরেন, প্রকাশ্যে গালে চুম্বনও করেন। এরপর বাচ্চু গিটার হাতে তুলে নেন কালজয়ী গান ‘সেই তুমি’, আর পাশে দাঁড়িয়ে গলা মেলান আজম খান। সেই রাতের স্মৃতি বাচ্চুর কাছে আজীবন ছিল এক বিশেষ প্রাপ্তি।
৩. মালিবাগের ঘরে জন্ম যে কালজয়ী গানের
বাংলা ব্যান্ডসংগীতের অন্যতম সেরা গান ‘চলো বদলে যাই’ সৃষ্টি হয়েছিল এক বসাতেই। ১৯৯৩ সালে মালিবাগের বাসায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে গানটি লিখে ফেলেন, সুর করেন আর গেয়ে ফেলেন বাচ্চু।
পরে এটি স্থান পায় ১৯৯৪ সালের ‘সুখ’ অ্যালবামে। প্রকাশের পর থেকেই গানটি হয়ে ওঠে যুগান্তকারী, যা আজও নতুন প্রজন্মকে আলোড়িত করে। বাচ্চু হয়ত নিজেও ভাবেননি, একদিন এটি শ্রোতাদের হৃদয়ে কালজয়ী আসন গড়ে নেবে।
৪. রিস্টব্যান্ড ছিল তার উদ্যমের প্রতীক
ফ্যাশনের ব্যাপারেও ছিলেন দারুণ সচেতন। সৌভাগ্য ও উদ্যমের প্রতীক ভেবে ডান হাতে একাধিক রিস্টব্যান্ড ও ঘড়ি পরতেন তিনি। আঙুলে থাকত পাঁচটি আংটি - যার মধ্যে একটি এনগেজমেন্টের আরেকটি শাশুড়ির দেওয়া।
জিনসের সঙ্গে ভারী বুটজুতা, আর কনসার্টে সবসময় কালো পোশাক ছিল তার প্রথম পছন্দ। নিজের ভাষায়, ‘আমি ছোটবেলা থেকে কালো পোশাক পরি, আর আমি নিজেও কালো।’
৫. ‘যে গিটারে দেশ অপমানিত হয়, তা দ্বিতীয়বার বাজাই না’
গিটার ছিল তার প্রাণ, কিন্তু দেশের প্রশ্নে বাচ্চু ছিলেন একেবারেই আপোষহীন। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিল তার ব্যান্ড এলআরবি। সেখানে শো শেষে নিউইয়র্কের এক গিটার সেন্টারে একটি দামী গিটার বাজিয়ে দেখতে চাওয়ায় দোকান ম্যানেজারের অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য শুনেছিলেন তিনি - ‘এই দামী গিটার তোমার মত বাংলাদেশির জন্য নয়।’
অপমান ভুলতে পারেননি বাচ্চু। গিটার বাজিয়ে প্রমাণ করেছিলেন নিজের মুন্সিয়ানার, কিন্তু কিনতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘যে গিটারের জন্য দেশ অপমানিত হয়, সেই গিটার আমি দ্বিতীয়বার বাজাই না।’ গিটারের প্রতি ভালোবাসা ছিল তার নেশা, কিন্তু দেশের সম্মান ছিল তার কাছে সবচেয়ে বড়।
আইয়ুব বাচ্চু শুধু একজন গায়ক বা গিটারিস্ট নন, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের ইতিহাস বদলে দেওয়া এক যোদ্ধা। তার প্রতিটি গান, প্রতিটি সুর ভক্তদের মনে আজও সমানভাবে বেঁচে আছে। জন্মদিনে তাকে মনে পড়ছে কোটি শ্রোতার, যাদের হৃদয়ে তিনি চিরকাল রুপালি গিটারের ঝংকার হয়ে বাজবেন।