দিগন্তজোড়া মাঠে শীতের শিশির ভেজা সকালে ঘন কুয়াশার চাঁদরে মোড়ানো সরিষার হলুদ ফুল রঙিন হয়ে উঠেছে। সবুজ গাছের ফুলগুলো শীতের সোনাঝরা রোদে যেন ঝিকিমিকি করছে। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই মনে হচ্ছে সরষে ফুলের হলুদ চাদরে ঢেকে আছে চারদিক। এ যেন এক অপরূপ সৌন্দর্যের দৃশ্য। দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতি কন্যা সেজেছে গায়ে হলুদ বরণ সাজে।
সিরাজগঞ্জের ৯টি উপজেলার বিভিন্ন ফসলের মাঠে হিমেল বাতাসে এভাবেই দোল খাচ্ছে হলুদ সরিষা ফুল। দূর থেকে সরিষার ক্ষেতগুলো দেখে মনে হয়, কে যেন হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। সরিষা ফুলের হলুদ রাজ্যে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত যেমন মাঠ, তেমনি বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষকরা।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে কৃষি প্রণোদনা পাওয়ায় জেলায় এবার সরিষার চাষ বেড়েছে। জেলার ৯টি উপজেলায় ৮৬ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। যদিও এ চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯০ হাজার হেক্টর। তবে বিগত বছরের তুলনায় এবার ১ হাজার ২৯০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ বেড়েছে। এ বছর কৃষি কর্মসূচির আওতায় ৮২ হাজার ৬০০ জন কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৭১ হাজার কৃষকই সরিষা চাষে প্রণোদনা নিয়েছেন।

কৃষকরা জানান, গত বছর আশানুরূপ দাম পাওয়ায় এবং কৃষি বিভাগ সরিষা চাষে প্রণোদনা দেওয়ায় চলতি মৌসুমে কৃষকেরা সরিষা চাষে আগ্রহী হয়েছেন। এ বছর জেলায় সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন।
রায়গঞ্জ উপজেলার খামারগাতী গ্রামের কৃষক জামিরুল ইসলাম বলেন, গত বছর ২ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছিলাম। বিঘা প্রতি খরচ হয়েছিল ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। ফলন পেয়েছিলেন ১২ মণ। প্রতি মণ সরিষা ৩ হাজার দরে ৩৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন।

তিনি আরও বলেন, গত বছর সরিষা চাষে আশানুরূপ লাভ হওয়ায় এবার ৪ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। আশা করছি এবারও ভালো ফলন ও ভালো দাম পাবো।
সলঙ্গার রামকৃঞ্চপুর গ্রামের কৃষক মহিদুল আলম জানান, এবার তিনি ৬ বিঘা জমিতে রবি সরিষার আবাদ করেছেন। এ জন্য কৃষি অফিস থেকে সার বীজ পেয়েছেন। তার জমিতে আগাম সরিষার ফুলে ভরে গেছে। তিনি আশা করছেন প্রতি বছরের মতো এবারও ভালো ফলনের।
তিনি আরও বলেন, আগে অনেক কৃষক সরিষা চাষ করতেন। আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় তারা চাষ কমিয়ে দিয়েছিলেন। বাজারদর ৩ হাজার টাকার বেশি থাকলে কৃষকেরা সরিষা চাষে আরও বেশি উৎসাহী হবেন বলে মন্তব্য করেন এ কৃষক।

উল্লাপাড়ার পূর্ণিমাগাঁতী গ্রামের কৃষক মুস্তফা কামাল বলেন, গত বছর ৪ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছিলাম। এবছর কৃষি বিভাগ থেকে বীজ ও সার প্রণোদনা পাওয়ায় ১০ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। গত বছর সরিষার ফলন ভালো ছিল, দামও ভালো পেয়েছি। এবার প্রতি বিঘা জমিতে ৬-৭ মণ সরিষা পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তিনি। গত বছর সরিষার পরে বোরো লাগানোর কারনে ধানের ফলনও ভালো হয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছেন।
সদর উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, দাম পাওয়া যায় না বলে সরিষা চাষ ছেড়ে দিয়েছিলাম। গত বছর ১ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছিলাম, দাম ভালো পেয়েছি। তাই এবার ২ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করছি।

অপরদিকে, ফসলের মাঠ হলুদের চাদরে ঢাকা পড়তে থাকায়, পোশা মৌমাছি দিয়ে ফুল থেকে মধু আহরণে এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েক শতাধিক মৌচাষী। তরা কৃষকদের জমির পাশে মৌমাছির বাক্স পেতে বসেছেন। বাক্সে থাকা মৌমাছির দল সরিষার ফুল থেকে ফুলে গুন গুন শব্দে মধু আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছে।
সলঙ্গা থানার হাটিকুমরুল এলাকার মৌ-চাষী আব্দুর রশিদ জানান, চলতি মৌসুমে সরিষা ফুল থেকে তার খামারের মৌমাছি দিয়ে প্রায় ১২ টন মধু আহরণের আশা করছেন। যা তিনি ১২ হাজার টাকা মণ দরে পাইকারী বিক্রি করবেন। তার মতো প্রায় ৩ শতাধিক মৌচাষী এ মৌসুমে সিরাজগঞ্জসহ চলনবিল এলাকা থেকে সরিষা ফুল থেকে মধু আহরণ করবে। এর মাধ্যমেও কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক বেকার খামারী যুবকের। পাশাপাশি উৎপাদিত মধু দেশের বাজারের চাহিদা পূরণ করায় আমদানি কমে আসছে।

সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আ. জা. মু. আহসান শহীদ সরকার বলেন, সরিষা ৩ মাস মেয়াদি ফসল। কম খরচ ও কম পরিশ্রমে সরিষা চাষ করতে পারেন কৃষকেরা। বর্তমানে সরিষা চাষ কৃষকের কাছে লাভজনক ফসলে পরিণত হয়েছে। এবার জেলার ৭১ হাজার কৃষককে সরিষা বীজ ও সার প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। গত বছর সরিষার আশানুরূপ ফলন ও দাম পাওয়ায় কৃষকেরা উৎসাহী হয়েছেন। সরিষা চাষ একদিকে যেমন মাটির উর্বরতা বাড়ায়, অন্যদিকে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তিনি আরও জানান, এ মৌসুমে সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে প্রায় ৪০০ টন মধু আহরণ হবে। আশা করছি, কৃষকরা সরিষার ভালো ফলনে লাভবান হবেন। এখানকার উৎপাদিত সরিষার তেল দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণেও বড় ভূমিকা রাখবে।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন