বাংলাভাষায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ- ‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ সাধারণত দুঃসময়ে কেউ ভাবলেশহীন হয়ে নিজের কাজ করতে থাকলে এই প্রবাদ ব্যবহার হয়।
এখন প্রশ্ন হতে পারে নিরো আসলে কে? তিনি কি সত্যিই রোম নগরী আগুনে পুড়ে যাওয়ার সময় বাঁশি বাজাচ্ছিলেন?
প্রথমেই জানা যাক নিরোর পরিচয় সম্পর্কে। রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জুলিও-ক্লদিয়ান বংশের শেষ শাসক ছিলেন নিরো। ৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পঞ্চম সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন নিরো।
ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত বেহিসাবি ছিলেন নিরো। প্রচলিত আছে, তিনি একটি প্রাসাদ নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছিলেন। তবে তিনি ছিলেন ক্রীড়াভক্ত। খেলাধুলা কিংবা ঘোড়দৌড়ের পেছনে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন।
এবার আলোচনা করা যাক রোম নগরী আগুনে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে। প্রচলিত আছে, রোমে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছিল চৌষট্টি খ্রিষ্টাব্দে। ছয়দিন চলা এ অগ্নিকাণ্ডে রোমের ১৪টি জেলার মধ্যে ১০টি জেলাই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল, যা এক নির্মম ঘটনা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নেয়।
অনেকে মনে করেন, রোমে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন নিরো নিজেই। কারণ তিনি সেখানে তার স্থাপত্যকর্ম ‘ডোমাস অরিয়া’ বা ‘স্বর্ণগৃহ’ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।
রোম আগুনে পোড়ার পরবর্তী সময়ে যখন নিরো তার স্থাপত্যকর্ম নির্মাণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তখন এ বিষয়ে যুক্তি আরও জোরালো হয়। আর তাই অনেকে মনে করেন রোম নগরী আগুনে পোড়ার সময় নিরো মনের খুশিতে তার প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।
তবে মজার বিষয় হলো প্রবাদটিতে ‘নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’- এ কথা বলা হলেও ইতিহাসে লেখা আছে, তিনি সে সময় বেহালা বাজাচ্ছিলেন। আর এটি পরবর্তীকালে লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে বাঁশিতে রূপ নেয়। তবে একটু ভেবে দেখুন তো, যে সময় ঘটনাটি ঘটেছিল সে সময় কি নিরোর পক্ষে বেহালা বাজানো আসলেই সম্ভব ছিল?
দাবি করা হয়, রোমান সম্রাটদের মধ্যে সবচেয়ে ‘নিষ্ঠুর’ ও ‘পাগলাটে’ শাসক নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সেই দাবি থেকে বাংলায় বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’ কার্যক্ষেত্রে বারবারই উচ্চারিত হয়। বিশ্বজুড়েই মানুষ এটা বিশ্বাস করে।
তবে প্রবাদের সত্যতা সর্বজনীন নয়। প্রবাদটির ইংরেজি শব্দগুচ্ছ থেকে সন্দেহের সূত্রপাত হয়েছে। ইতিহাসভিত্তিক টিভি চ্যানেল হিস্ট্রি ডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘Nero fiddles while Rome burns’— এই প্রবাদে ‘Fiddle’ (ফিডল) বা বেহালার মতো যে বাদ্যযন্ত্রের কথা বলা হয়, প্রাচীন রোমে সেটির অস্তিত্বই ছিল না।
হিস্ট্রি চ্যানেলের বর্ণনার কাছাকাছি ভাষ্য পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নিরোবিষয়ক এক প্রতিবেদনে।
সংগীতবিষয়ক ইতিহাসবেত্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি জানায়, ফিডল নামে বাদ্যযন্ত্রটির অস্তিত্ব ১১ শতকের আগপর্যন্ত ছিলই না। তখন নিরো যদি কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েই থাকে, তাহলে সেটা হতে পারে ‘কিতারা’ নামের বাদ্যযন্ত্র, যেটাকে আধুনিক কালের গিটার বলা যায়। এটি ছিল চার থেকে সাত তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র। তবে রোমের অগ্নিকাণ্ডের সময় নিরো বাজিয়েছিলেন তেমন অকাট্য প্রমাণ নেই।
এ বিষয়ে প্রাচীন রোমের ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস বলেন, ‘রোমে যখন অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল তখন নিরো রোম থেকে ৩৫ মাইল দূরে এন্টিয়াম শহরে ছিলেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা শুনে নিরো দ্রুত রোমে আসেন এবং আগুনে বিধ্বস্ত মানুষের সেবায় ত্রাণকার্য পরিচালনা করেন।’
আরেকটি মজার বিষয় হলো রোমে অগ্নিকাণ্ডের সময় নিরোর বাঁশি বাজানোর বিষয়টি সবার কাছে প্রচলিত হয় অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ১৫০ বছর পর। কারণ অগ্নিকাণ্ডের পরপরই নিরো যখন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তার স্থাপনা ‘ডোমাস অরিয়া’ নির্মাণ শুরু করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্য নিরোকে সন্দেহ করতে থাকে।
আর এভাবেই প্রবাদটি একসময় মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
নিরোর সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাকিটাস দাবিটির সূত্রপাত সম্পর্কে লেখেন, ‘রোম আগুনে পোড়ার সময় নিরো ধ্বংসযজ্ঞ দেখছিলেন এবং উপভোগ করছিলেন—এমন গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় এই দাবির কোনো সত্যতা নেই।’
অগ্নিকাণ্ডের খবর জেনে নিরো অ্যান্টিম থেকে তাৎক্ষণিক রোমে ফিরে আসেন এবং ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর প্রতি আস্থাহীনতার কারণে অনেকেই বিশ্বাস করত, রোমের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিরোর নির্দেশেই হয়েছে। তবে এর কিছু কারণও আছে—আগুনে পুড়ে খালি হওয়া জায়গায় নিজের জন্য রাজপ্রাসাদ ও বিলাসী বাগান গড়ে তোলেন নিরো।
আবার ঘটনার জন্য খ্রিষ্টানদের দায়ী করেন এবং এই কারণে অনেককে গ্রেপ্তার ও প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। তবে নিরোর কুখ্যাতি থাকলেও রোমের আগুনের ঘটনায় তাঁর বাঁশি বাজানোর দাবিকে ‘বহুল প্রচলিত রূপকথা’ বলাই শ্রেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ইমেরিটাস অধ্যাপক (গবেষণা) হ্যারল্ড ড্রেক বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্সকে বলেন, ‘নিরো সম্পর্কে যেসব ইতিহাস পাওয়া যায়, সেসব ইতিহাসের রচয়িতারা সবাই ছিল তাঁর প্রতিপক্ষ।’
যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের নিরো প্রজেক্টের কিউরেটর প্রত্নতাত্ত্বিক ফ্রান্সেসকা বোলোগনাও ড্রেকের এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।
ড্রেক বলেন, ‘আগুনের ঘটনার পরপরই নিরো রোমে ফিরে এসে বিপন্নদের জন্য আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেন। এমনকি আশ্রয়প্রার্থী মানুষের জন্য নিজের প্রাসাদ ও বাগান পর্যন্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তিনি। তাহলে ‘রোম যখন আগুনে পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’ এই গল্প কীভাবে এলো?’
এ প্রসঙ্গে ড্রেক বলেন, ‘নিরো নিজেকে গায়ক ভাবতে পছন্দ করতেন। রোমের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার মানুষের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম চলার সময়ই তাঁকে নিয়ে গুজবটি ছড়িয়ে পড়ে যে, রোমের আগুনের সময় নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। এ ছাড়া নিজের শৈল্পিক ঝোঁক থেকেই তিনি এ অগ্নিকাণ্ডকে ট্রয়ের পতনের সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।’
তাহলে কেন ইতিহাস নিরোকে খারাপ শাসক হিসেবে দেখায়?- এমন প্রশ্নের উত্তরে ড্রেক বলেন, ‘সম্রাট নিরো সম্পর্কে আধুনিক বিশ্বে যত তথ্য পাওয়া যায়, তার প্রায় সবগুলোই রোমান সিনেটর ও খ্রিষ্টানদের দ্বারা রচিত এবং উভয়ই ছিল নিরোর ঘোর শত্রু।’