পারস্য সভ্যতা ছিল প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ও বিস্তৃত একটি সভ্যতা, যা বহু জাতি ও সংস্কৃতির মিশ্রণে গঠিত এক শঙ্কর সভ্যতায় পরিণত হয়েছিল। এ সভ্যতা পূর্ববর্তী মিসরীয়, ক্যালডীয়, অ্যাসেরীয়, লিডীয় এবং উত্তর প্যালেস্টাইন অঞ্চলের সভ্যতা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়।
পারস্য সাম্রাজ্যের সূচনা
খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৯ অব্দে পারসিক নেতা সাইরাস দ্য গ্রেট (Cyrus the Great) শেষ ক্যালডীয় রাজা বেলসেজজার-কে পরাজিত ও নিহত করে পারস্য সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। তার শাসনেই পারস্য বিশ্বের প্রথম বৃহৎ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়, যা ভারতের সিন্ধু নদ থেকে শুরু করে ইজিয়ান সাগর পর্যন্ত এবং ভারত মহাসাগর থেকে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
শাসন ব্যবস্থা ও সামরিক শক্তি
সাইরাসের উত্তরসূরিরা সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি অব্যাহত রাখেন। পারস্য শাসকরা একটি সুসংগঠিত ও বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তারা সাম্রাজ্যকে ‘সাত্রাপি’ নামে পরিচিত প্রদেশে বিভক্ত করেন, যার প্রত্যেকটির দায়িত্বে একজন গভর্নর (সাত্রাপ) নিযুক্ত থাকতেন। দারায়ুসের শাসনামলে ‘রাজার রাস্তা’ (Royal Road) নির্মিত হয়, যা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত করত।
পারস্য সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষায় ছিল শক্তিশালী, সুশৃঙ্খল ও পেশাদার সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীকে ৬টি ইউনিটে ভাগ করা হয়েছিল, প্রতিটি ইউনিটে ১০ হাজার করে সৈন্য থাকত।
সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা ছিল- তীরন্দাজ বাহিনী ও বর্শা নিক্ষেপকারী বাহিনী।
সম্রাটের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিযুক্ত ছিল বিশেষ বাহিনী- ‘অমর বাহিনী’, যার সদস্যসংখ্যা ছিল ১০ হাজার এবং তারা সব সময় প্রস্তুত থাকত।
দারায়ুস তার সেনাবাহিনীতে কেবল পারসিক ও মিডিয়ান নয়, বরং গ্রিক, ভারতীয় এবং বিভিন্ন যাযাবর জাতির তীরন্দাজদেরও অন্তর্ভুক্ত করেন। সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলসমূহে স্থায়ী সেনাঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছিল, যেগুলোর মধ্যে মিসরের এলিফেনটাইনের ঘাঁটি অন্যতম।
নৌবাহিনী গঠন ও সামুদ্রিক শক্তি
সম্রাট দারায়ুস দ্য গ্রেট পারস্যের প্রথম সংগঠিত নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। এই নৌবাহিনীর জন্য জাহাজ নির্মাণে ফিনিশীয়দের নৌ নির্মাণ কৌশল গ্রহণ করা হয়। ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের উপকূল পাহারায় এবং গ্রিস আক্রমণে পারস্য নৌবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দারায়ুস পুরনো খালসমূহ সংস্কার করে সমুদ্র যোগাযোগ আরও সহজ করে তোলেন, যা পারস্যের বাণিজ্য ও সামরিক অভিযানে সহায়ক ছিল।
ইসলামের আগমন ও সামরিক প্রতিপত্তি
ইসলাম পারস্যে প্রবেশ করে ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে, খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে। পরবর্তীতে হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ইসলামিক বিজয় সম্পূর্ণ রূপে বিস্তৃত হয়।
পারস্যের সেনাবাহিনী সেই সময়েও ছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী।
খ্যাতিমান সাহাবি ও সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) বলেন, ‘মুতার যুদ্ধে আমার হাতে নয়টি তরবারি ভেঙে গিয়েছিল শত্রুর প্রতিরোধে। কিন্তু পারস্য বাহিনীর মতো এত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ আর কোথাও দেখিনি।’