ঢাকা রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৫

এক নদী-এক পাইলট, প্রাণ বাঁচাল ১৫৫ জনের

ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ২৬, ২০২৫, ০২:৩৪ পিএম
বিমানটি ও ক্যাপ্টেন সুলি। ছবি- সংগৃহীত

২০০৯ সালের জানুয়ারির এক শীতল বিকেলে, নিউইয়র্কের লাগার্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে ইউএস এয়ারওয়েজ ফ্লাইট-১৫৪৯ উত্তর ক্যারোলিনার শার্লট শহরের উদ্দেশে উড্ডয়ন করেছিল। প্লেনে ছিলেন ১৫১ জন যাত্রী ও ৫ জন ক্রু। প্রত্যেকেই ভেবেছিলেন, এটা হবে এক সাধারণ ভ্রমণ। কিন্তু পরের কয়েক মিনিটে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি আজকের দিনেও ইতিহাসে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয়- ‘হাডসনের অলৌকিকতা’।

এটি সাহস, দ্রুত চিন্তাভাবনা এবং মানবজীবনের প্রতি অদম্য ইচ্ছাশক্তির এক অসাধারণ গল্প।

ইচ্ছাশক্তি

উড্ডয়নের মাত্র কয়েক মিনিট পরই ফ্লাইট-১৫৪৯ এক ভয়াবহ মুহূর্তের মুখোমুখি হয়। নিউইয়র্ক শহরের উপরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই এক ঝাঁক রাজহাঁসের সঙ্গে বিমানটির সংঘর্ষ ঘটে।

এই সংঘর্ষে বিমানের দুটি ইঞ্জিনই বন্ধ হয়ে যায়। মুহূর্তেই অবস্থা হয়ে ওঠে সংকটাপন্ন। পাইলট ক্যাপ্টেন চেসলি ‘সুলি’ সুলেনবার্গার ও সহকারী পাইলট জেফরি স্কাইলস বুঝতে পারেন, বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারাতে চলেছে। বিমানটি ছিল প্রায় ৩০০০ ফুট উচ্চতায়, নিউইয়র্কের একেবারে উপরে- যেখানে প্রচুর জনবসতি, বড় বড় বিল্ডিং এবং রাস্তা। এত অল্প সময়ে সংকট মোকাবিলা করা ছিল খুবই কঠিন।

ঝুঁকি ও সিদ্ধান্ত

ক্যাপ্টেন সুলির সামনে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় ছিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার। পেছনে ফিরে গিয়ে লাগার্ডিয়া বিমানবন্দরে অবতরণ বা কাছাকাছি টেটারবোরো বিমানবন্দরে পৌঁছানো- দুটোই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই উড়োজাহাজের উচ্চতা ও গতি খুব কম ছিল। অন্যদিকে, গাঢ় ঘন শহরের মধ্যে জ্বলন্ত ইঞ্জিন নিয়ে নামার মানেই এক বিশাল দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা।

ক্যাপ্টেন সুলি।

তাই সুলি মনস্থির করে এক অভিনব পদক্ষেপে- তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরাসরি হাডসন নদীর বরফ ঠান্ডা জলে অবতরণ করবেন। এটি ছিল একটি বিশাল নদী, যেখানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, আর সুলির পদক্ষেপ ছিল এক যুগান্তকারী। যা ছিল ১৫৫ জন যাত্রীর প্রাণ বাঁচানোর জন্য এক কঠিন সিদ্ধান্ত।

নদীর ওপর অবতরণ

তখন বিকেল সাড়ে ৩টা। ফ্লাইট-১৫৪৯ হাডসন নদীর ওপর নামতে শুরু করে। যাত্রীরা কেবিনে ‘ব্রেস ফর ইম্প্যাক্ট’ সংকেত পেয়ে তাদের শরীরকে সুরক্ষিত অবস্থানে নিয়ে যায়। ভয় আর আতঙ্ক স্পষ্ট, কিন্তু অভিজ্ঞ ক্রুদের নির্দেশে সবাই প্রস্তুত।

ক্যাপ্টেন সুলির স্নায়ু ছিল ইস্পাতের মতো অটল। তিনি বিমানটিকে এমন নিখুঁতভাবে নদীর পৃষ্ঠে অবতরণ করান, যা কোনো সিনেমার দৃশ্যকে হার মানাবে। অবতরণটা যদিও ঝাঁকুনি ও শোরগোলময় ছিল, তবে তা বিমানটির জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হয়নি।

বিমানটি যখন হাডসনের পানি স্পর্শ করে, তখন সবাই বুঝতে পারেন, তাদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। বিমানটি জলে ভাসতে থাকে, আর যাত্রীরা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য প্রস্তুত হয়।

নদীতে অবতরণের মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে, ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায় ফেরি, উদ্ধারকারী নৌকা, পুলিশ ও জরুরি সেবাদল। যাত্রীরা নদীর পানিতে ডুবে যাওয়ার পরিবর্তে বিমানের ডানার ওপর দাঁড়িয়ে একে অপরের হাত ধরে থাকছিলেন, তারা কেউ কাউকেই এক মুহূর্তের জন্যেও হতাশ হতে দেননি।

দ্রুত এবং সুচারুভাবে পরিচালিত উদ্ধারকর্মীদের কারণে, মাত্র ২৪ মিনিটের মধ্যে বিমানের ১৫৫ জন যাত্রী ও ক্রুকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়।

জানা যায়, এ ঘটনায় কেউ কোনো আঘাতপ্রাপ্ত  হননি, প্রাণ হারানো তো দূর কথা।

বিশ্বজুড়ে প্রশংসা

এ ঘটনার পর ক্যাপ্টেন সুলির দক্ষতা ও নেতৃত্বকে সর্বত্র উচ্চ পর্যায়ে সম্মানিত করা হয়। তিনি মাত্র কয়েক সেকেন্ডে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা অনেকের জীবন বাঁচিয়েছে।

নিউইয়র্কের মানুষ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সম্প্রদায় পর্যন্ত সবাই এই ঘটনা নিয়ে বিস্মিত। এটি শুধু বিমান চালানোর ইতিহাস নয়, মানবতার ও সংকট মোকাবিলার এক প্রেরণামূলক গল্প।