অফিসের চাপ কি আপনার জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে? কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত মানসিক চাপ শুধু কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয় না, বরং শরীর ও মনের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। এ চাপ কমানোর রয়েছে বেশ কিছু কার্যকর কৌশল।
কেন কর্মক্ষেত্রে চাপমুক্তি প্রয়োজন
অফিসে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় কাজ, মিটিং, ইমেইল, নির্ধারিত সময়সীমা পূরণ- এসব মিলিয়ে মানসিক চাপ প্রায় অবশ্যম্ভাবী। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে ক্লান্তি, বার্নআউট এমনকি স্বাস্থ্যহানিও ঘটতে পারে। তাই অফিসের জন্য চাপ উপশমের উপযোগী কৌশল জানা ও প্রয়োগ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চাপের সাধারণ কারণ
কর্মক্ষেত্রে চাপের মূল উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে- কম বেতন, কাজের চাপ, উন্নতির কম সুযোগ, অস্পষ্ট কর্ম-প্রত্যাশা, সিদ্ধান্তের ওপর নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং সামাজিক সমর্থনের অভাব। এসব কারণ থেকে উদ্ভূত চাপ আমাদের কর্মক্ষমতা ও মনোযোগে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
চাপ কমানোর ১২টি কৌশল, যা অফিসের কাজে চাপ কমাতে সহায়তা করবে।
১. দিনের সঠিক শুরু
দিনের শুরুটা যেভাবে হয়, সারা দিনের মানসিক অবস্থা ততটাই প্রভাবিত হয়। তাই সকালে নিজের জন্য কিছু সময় বের করে ধ্যান, হালকা ব্যায়াম অথবা মাত্র ৫-১০ মিনিটের শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে পারেন।
গবেষণায় প্রমাণিত যে, সফল ও মানসিকভাবে স্থিতিশীল মানুষরা সাধারণত তাদের বিছানা গুছিয়ে রাখেন এবং স্বাস্থ্যকর নাস্তা করেন, যা মনকে ফোকাস রাখতে সাহায্য করে। সকালে প্রোটিন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে সারাদিন সতেজ ও শক্তিশালী থাকার সুযোগ বেশি থাকে।
২. প্রকৃতির ছোঁয়া মানসিক চাপ কমায়
অফিস জীবনের দৌড়ঝাপের মাঝে মাঝেই একটু বাইরে বের হয়ে হাঁটা-দৌড়ানো বা হালকা ব্যায়াম করুন। বাইরের তাজা বাতাস এবং সবুজ প্রকৃতি দেখতে পেলে কর্টিসল (স্ট্রেস হরমোন) কমে যায়, হৃদস্পন্দন ধীর হয়, আর মন প্রশান্ত হয়।
যদি অফিসে বাইরে বের হওয়া সম্ভব না হয়, তবুও কয়েক মিনিটের জন্য স্ট্রেচিং বা হালকা হাঁটার মাধ্যমে শারীরিক উত্তেজনা কমানো যায়।
৩. শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম
গভীর ও মনোযোগী শ্বাস-প্রশ্বাস মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। যেমন...
মননশীল শ্বাস: চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে শ্বাস নিন ও ছাড়ুন, গুনতে গুনতে।
পেটের শ্বাস: পেট প্রসারিত করে গভীর শ্বাস নিন, এতে ফুসফুস পুরোপুরি কাজ করে এবং শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ বাড়ে।
৪x৪x৪ শ্বাস: ৪ সেকেন্ড শ্বাস নিন, ৪ সেকেন্ড ধরে রাখুন, ৪ সেকেন্ডে ছাড়ুন।
বিকল্প নাসারন্ধ্র শ্বাস: এক নাসারন্ধ্র বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে অন্য নাসারন্ধ্র দিয়ে ছাড়ুন, তারপর বদলে করুন।
এই পদ্ধতিগুলো মাত্র ৫-১০ মিনিট করলেই স্ট্রেস লেভেল অনেক কমে যায়।
৪. ছোট বিরতি, বড় লাভ
কাজের মাঝে মাঝে মনকে অবাধে ঘুরতে দেওয়া (দিবাস্বপ্ন) মস্তিষ্কের চাপ কমায় এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। বিরতি নিয়ে কয়েক মিনিট শুধু ভাবুন বা ছোট করে চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিন। এতে নতুন চিন্তার জন্ম হয় এবং চাপ কমে।
৫. মস্তিষ্ক চাপমুক্ত করুন
কাঁধ, ঘাড়, মাথা ও পিঠে জমে থাকা চাপ দ্রুত মুক্তির জন্য অফিসে বা ডেক্সে বসে স্ট্রেচিং করুন।
মুখের পেশী শিথিল: মুখ খুলে টান দিন এবং মুচড়ে নিন, এটি মনকে শিথিল করে।
কাঁধের প্রসারণ: শ্বাস নিন, কাঁধ কানের দিকে তুলুন, শ্বাস ছাড়ার সময় শিথিল করুন।
ঘাড়ের টান কমানো: মাথা ধীরে ধীরে একপাশে ঝুঁকিয়ে ঘাড়ের চাপ কমান।
এছাড়াও পেটে টান থাকলে শুয়ে পেট শিথিল করার ব্যায়াম করুন।
৬. মনোযোগ বজায় রাখুন
বহু কাজ এক সঙ্গে করার চেষ্টা মানসিক চাপ বাড়ায় এবং উৎপাদন কমায়। কাজ করার সময় মোবাইল, ইমেল বা মেসেঞ্জারের বিজ্ঞপ্তি বন্ধ রাখুন। অফিসে ‘ফোকাস মোড’ চালু করুন এবং সহকর্মীদের জানিয়ে দিন আপনি নির্দিষ্ট সময়ে ব্যস্ত থাকবেন। এর ফলে মনোযোগ বাড়ে এবং দ্রুত কাজ শেষ করা যায়।
৭. গাছপালা ও পোষা প্রাণীকে ভালোবাসুন
অফিসে গাছপালা মানসিক চাপ কমায়, কারণ সবুজ রং দেখতে মস্তিষ্ক স্বস্তি পায়। গাছগুলো অক্সিজেনের পাশাপাশি মনের শান্তি দেয়। যদি সম্ভব হয়, পোষা প্রাণীর সান্নিধ্যে থাকুন বা তাঁদের সঙ্গে একটু সময় কাটান।
গবেষণায় দেখা গেছে, পোষা প্রাণীর সঙ্গে খেলা স্ট্রেস হরমোন কমায় এবং মন ভালো রাখে।
৮. কাজের মাঝে মজা
কর্মক্ষেত্রে খেলাধুলা এবং বিনোদন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। অফিসে ছোটখাটো খেলা বা চ্যালেঞ্জ শুরু করুন যেমন ফ্যান্টাসি লিগ, স্ক্র্যাবল, হাঁটার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।
এতে দলের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত হয় এবং মনোবল বাড়ে, যা চাপ কমানোর জন্য জরুরি।
৯. আবেগকে না বলুন
দৈনন্দিন কর্মজীবনের চাপ, অনুভূতি ও চিন্তা লিখে রাখা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। অফিসে ছোট একটি জার্নাল রাখুন যেখানে আপনি আপনার কাজের অগ্রগতি, অনুভূতি ও চাপের কারণ লিখতে পারেন। এটি আবেগকে বুঝতে ও নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি কার্যকর পদ্ধতি।
১০. আর্থিক সুস্থতা
অর্থনৈতিক উদ্বেগ কর্মীদের মানসিক চাপের বড় কারণ। অফিসে আর্থিক পরিকল্পনা ও পরামর্শ কর্মসূচি চালু করলে কর্মীরা আর্থিক বিষয়ে সচেতন ও শান্ত থাকতে পারে। বাজেট তৈরি, সঞ্চয় পরিকল্পনা ও ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি নিয়ে কর্মীদের সাহায্য করার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে চাপ কমানো সম্ভব।
১১. আধুনিক সুবিধা
অনলাইন যোগব্যায়াম, ধ্যান, কাউন্সেলিং এবং কোচিং সেশন কর্মীদের মানসিক সুস্থতায় বড় ভূমিকা রাখে। কর্মীরা যেকোনো সময়, যেকোন স্থানে থেকে ভার্চুয়াল এই সেবাগুলো পেতে পারেন, যা চাপ কমাতে অনেক সাহায্য করে।
১২. শরীর ও মনের বোঝাপড়া
অফিসে নিয়মিত ম্যাসাজ কর্মীদের শরীরের টান ও মানসিক চাপ দূর করে। ১০-৩০ মিনিটের চেয়ার ম্যাসাজ মাত্রা বার্নআউট কমায় এবং মন ভালো রাখে। ম্যাসাজের ফলে রক্ত সঞ্চালন ভালো হয়, পেশী শিথিল হয়, এবং চাপ কমে, ফলে কর্মক্ষমতা বাড়ে।