ঢাকা মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫

নিয়ম মেনে চললে কি সত্যিই বেশি দিন বাঁচা সম্ভব?

ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২৫, ১১:৩৫ এএম
ছবি- সংগৃহীত

মানুষের জীবনের দীর্ঘায়ু নিয়ন্ত্রণ করা প্রায়শই মানুষের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞান, সামাজিক সংস্কৃতি ও জীবনধারা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছে- নিয়ম মেনে চললে কি সত্যিই আমরা বেশি দিন বাঁচতে পারি? আধুনিক গবেষণা ও জীবনধারার অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া তথ্যগুলো এই প্রশ্নের জবাবের অনেকটা স্পষ্টতা এনে দিয়েছে।

দীর্ঘায়ুর গাণিতিক হিসাব

একজন মানুষের জীবনকাল নির্ধারণে জিনগত প্রভাব থাকে প্রায় ২০-৩০ শতাংশ এবং বাকি ৭০-৮০ শতাংশ নির্ভর করে তার জীবনধারা ও পরিবেশের ওপর। অর্থাৎ, আমরা হয়তো জন্মসূত্রে নির্ধারিত কিছু সীমার মধ্যেই থাকি, কিন্তু যেভাবে জীবনযাপন করি তা বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। নিয়মিত স্বাস্থ্যকর অভ্যাস যেমন সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষণাবেক্ষণ, শরীরচর্চা, ওষুধপান ও ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা দীর্ঘায়ুর অন্যতম প্রধান উপাদান।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস ও দীর্ঘায়ু

আমাদের খাবার শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি। তাই খাদ্যের ধরন ও মান সরাসরি জীবনের গুণগত মান ও আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে। বহু গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, শাকসবজি, ফলমূল, অল্প চর্বিযুক্ত প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট যেমন ওমেগা-৩ এবং পরিমিত ক্যালোরি গ্রহণ জীবনকাল বাড়াতে সহায়ক।

বিশ্বের বহু ‘ব্লু জোন’ অঞ্চল—যেমন জাপানের ওকিনাওয়া, ইতালির সর্ডিনিয়া—সেখানে মানুষের গড় আয়ু অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক বেশি। এসব অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভ্যাসে প্রচুর পরিমাণে তাজা সবজি, ফল, বাদাম এবং সামুদ্রিক খাবার থাকে। এছাড়াও, তারা অতিরিক্ত প্রসেসড বা ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলেন।

শরীরচর্চার ভূমিকা

নিয়মিত ব্যায়াম হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ও স্থূলতাসহ অনেক রোগের ঝুঁকি কমায়। ব্যায়াম শরীরের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, কোষগুলোকে অক্সিজেন ও পুষ্টি দ্রুত পৌঁছায়। শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক চাপ কমাতেও ব্যায়াম সাহায্য করে, যা দীর্ঘায়ুর জন্য অপরিহার্য।

বিশেষজ্ঞরা সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন। হেঁটে চলা, সাঁতার, সাইক্লিং কিংবা যোগব্যায়াম হতে পারে দারুণ বিকল্প।

মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব

শুধুমাত্র শারীরিক স্বাস্থ্যই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যও দীর্ঘায়ুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা শরীরের বিভিন্ন প্রতিরক্ষাকৌশল দুর্বল করে এবং হৃদরোগ ও অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

যোগ, মেডিটেশন ও পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। সামাজিক সম্পর্ক ও পারিবারিক বন্ধন মানসিক চাপ কমাতে এবং জীবনের মান বাড়াতে ভূমিকা রাখে।

ধূমপান, মদ্যপান ও অন্যান্য ক্ষতিকর অভ্যাস ত্যাগ

ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপান স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফুসফুসের ক্যানসার, হৃদরোগ, লিভার ডিজিজসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে এসব অভ্যাস। নিয়মিত ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করলে দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়।

সময়মতো স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসা

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রোগের প্রাথমিক লক্ষণ ধরার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক রোগ শুরুতে নিরাময়যোগ্য হলেও সময়মতো চিকিৎসা না করলে তা জটিল আকার ধারণ করতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ওষুধ সেবন দীর্ঘায়ু বাড়ানোর ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব

নিয়মিত স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ যেমন দূষণমুক্ত বায়ু, পরিচ্ছন্ন পানীয় জল, নিরাপদ আবাসন ও সমাজের সহায়ক পরিবেশও জীবনের গুণগত মান ও আয়ু বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের সমর্থন মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী।

নিয়ম মেনে চলার চ্যালেঞ্জ

আধুনিক জীবনের তাড়াহুড়া, কর্মব্যস্ততা ও প্রলোভন অনেক সময় স্বাস্থ্যকর অভ্যাস মেনে চলা কঠিন করে তোলে। ফাস্ট ফুডের সহজলভ্যতা, অনিয়মিত ঘুম, পরিশ্রমের অভাব এসব দীর্ঘায়ুর পথে প্রতিবন্ধকতা। তবু সচেতনতা ও পরিকল্পিত জীবনধারা অনুসরণ করলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব।

বাস্তব জীবন থেকে কিছু উদাহরণ

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বহু মানুষের দীর্ঘজীবনের গল্প আছে যারা নিয়ম মেনে চলার কারণে সুস্থ ও সক্রিয় জীবনযাপন করছেন। জাপানের ওকিনাওয়া, ইতালির সর্ডিনিয়া, গ্রিসের ইকারিয়া প্রভৃতি ব্লু জোন অঞ্চলের মানুষরা ৯০-১০০ বছর বয়স পর্যন্ত জীবন্ত ও সক্রিয় থাকার অন্যতম কারণ হলো তাদের জীবনযাত্রায় নিয়ম, শৃঙ্খলা ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস।

বাংলাদেশেও গ্রামীণ অঞ্চলের বহু মানুষ নিয়মিত কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, কম প্রসেসড খাবার খেয়ে সুস্থ জীবন কাটাচ্ছেন। তাদের দীর্ঘায়ুর কারণের মধ্যে একান্তই স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বড় ভূমিকা রাখে।

নিয়ম মেনে চললে দীর্ঘায়ু সম্ভব?

বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, নিয়ম মেনে চলা—যা মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে—দীর্ঘায়ুর সম্ভাবনা বাড়ায়। খাদ্যাভাস থেকে শুরু করে ব্যায়াম, ধূমপান পরিহার, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা–সব মিলিয়ে একটি সুশৃঙ্খল জীবনধারা দীর্ঘায়ুর মূল চাবিকাঠি।

তবে এটা মনে রাখা জরুরি যে, কেউ কেউ জিনগত কারণে বেশি দিন বাঁচতে পারে আবার কেউ কেউ না। তাই দীর্ঘায়ুর পেছনে একাধিক কারণ কাজ করে।

দীর্ঘায়ু কেবল জেনেটিক্সের ওপর নির্ভরশীল নয়, এটি একটি সচেতন জীবনধারা ও নিয়ম মেনে চলার ফল। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশের সম্মিলিত প্রয়াসই আমাদের জীবনকে সুস্থ, দীর্ঘ ও সুখময় করে তোলে।