শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: মে ১৬, ২০২৫, ০১:০০ এএম

বৃষ্টিতে বাড়ছে ডেঙ্গু,অবাস্তব পরিকল্পনার শঙ্কা

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: মে ১৬, ২০২৫, ০১:০০ এএম

বৃষ্টিতে বাড়ছে ডেঙ্গু,অবাস্তব পরিকল্পনার শঙ্কা

ছবি- সংগৃহীত

বছরের শুরুতেই সহকর্মীরা সাড়ম্বরে ফারিয়ার বাসায় আয়োজন করে সাধ (গর্ভবর্তী মায়ের খাবার ইচ্ছাপূরণ) অনুষ্ঠানের। এর এক মাসের মধ্যেই ঘর আলো করে জন্ম নেয় শিশুপুত্র যায়ান। কিন্তু জন্মের মাত্র ৩ মাসের মাথায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় সেই শিশুসন্তানটিকে নিয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দিন কাটাচ্ছেন ফারিয়া ও তার স্বামী।

রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুপুত্রের চিকিৎসায় দিন-রাত নির্ঘুম কাটাচ্ছেন স্বামী-স্ত্রী। চিকিৎসকরা বলেছেন, সুস্থ হয়ে উঠছে যায়ান। কিন্তু আশপাশের ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন ফারিয়া।  একইভাবে শিশুকন্যা সুপ্তিকে নিয়ে সুস্থতার প্রহর গুনছেন প্রিয়াসা ও বাপ্পা দম্পতি। 

রাজধানীর মুগদা মেডিকেলের শিশু ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৪ বছরের মেয়েকে নিয়ে যতটা না আতঙ্কিত তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত তারা হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার ধরন দেখে। বেশির ভাগ রোগীই মশারি ছাড়াই চিকিৎসা নিচ্ছেন দিনের পর দিন। প্রিয়াসা বলেন, যদিও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে রোগটি ছড়ায় না। কিন্তু অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগের ভয় তো থেকেই যায়। 

শুধু ফারিয়া বা প্রিয়াসা নন, সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণে আতঙ্কিত দিন কাটাচ্ছেন বেশির ভাগ অভিভাবকই। কিন্তু স্বাস্থ্যবিভাগসহ স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে মশা নিধনে নেই কার্যকর উদ্যোগ। এর পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নামে অবাস্তব কিছু পরিকল্পনা করছে সরকার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যা বাস্তবায়ন অনেকটাই কঠিন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

মে মাসের শুরু থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে কারো মৃত্যু না হলেও সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ছিল জ্যামিতিক হারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, মে মাসের ১ তারিখে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৪ জন। যা ২ তারিখে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ২৫ জনের দাঁড়ায়। ৩ তারিখে তারও প্রায় দ্বিগুণ ৪৩ জন আক্রান্ত হয়।

এভাবে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। ৪ তারিখে আক্রান্ত হয় ৫৩ জন, ৫ তারিখে ৪৯ জন, ৬ তারিখে ৬০ জন, ৭ তারিখে ৪২ জন, ৮ তারিখে ৪৫ জন, ৯ তারিখে কিছুটা কমে ২২ জন, তবে ১০ তারিখে আবার ৪৭ জন আক্রান্ত হয়। ১১ তারিখে আবারও কমে আক্রান্তের সংখ্যা। এদিন আক্রান্ত হয় ১৪ জন। তবে ১২ তারিখ অর্থাৎ সোমবার মাসের সর্বোচ্চ ৮২ জন আক্রান্ত হওয়ার খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

একইভাবে ১৩ তারিখ মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ৪৮ জন, ১৪ তারিখে ৮৩ জন, ১৫ তারিখে ৬৫ জন আক্রান্তের কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে করে মাসের ১৫ দিনেই আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯২ জনে। এতে করে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হন ৩ হাজার ২৬৪ জন। আর মৃত্যু হয় ২১ জনের।

আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে চলতি বছরের শুরু থেকেই ঢাকার বাইরে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি। এ পর্যন্ত মোট আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৪১৮ জন। বাইরের বিভাগগুলোতেই বেশি। বছরের শুরু থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ময়মনসিংহ বিভাগে আক্রান্ত হয়েছে ৭৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৮৬ জন, খুলনা বিভাগে ১৪১ জন, রাজশাহী বিভাগে ৬৪ জন, রংপুর বিভাগে ১১ জন, বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৪ জন, সিলেটে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ জন। মৃত্যুও হয়েছে বেশ কয়েকটি বিভাগে। এখনই প্রায় ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় ভরা মৌসুমে পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

২০২৩ ও ২০২৪ সালের প্রায় পুরোটা বছর দৌরাত্ম্য ছিল এডিসবাহী ডেঙ্গু মশার। ২০২৩ সালের শেষের দিকে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও ২০২৪-এর শুরু থেকে আবারও বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। চলতি বছরেও মৌসুম শুরুর আগেই আক্রান্ত এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান আতঙ্ক জাগাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের মনে। তাদের আশঙ্কা ঢাকার তুলনায় ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হওয়ায় জুলাই-আগস্টে ডেঙ্গুর বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

এর অন্যতম কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বাইরের অঞ্চলগুলোতে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে মশা নিধন কর্মসূচিতেও। দেশের কোনো সিটি করপোরেশনেই মেয়র বা কাউন্সিলর না থাকায় মশা মারতে নেই কার্যকর উদ্যোগ। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, এবার ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যৌথ উদ্যোগের পথে হাঁটছে সরকার।

পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে উলবাকিয়া ও সেরোলজিক্যাল জরিপ করা হবে। সেরোলজিক্যাল জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গু রোগে সংক্রমণের হার ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতি নিরূপণ করা হবে। রক্তের নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যাবে, কারা পূর্বে আক্রান্ত হয়েছেন এবং কোন এলাকায় ঝুঁকি বেশি।

এ ছাড়া ‘উলবাকিয়া’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এই পদ্ধতিতে মশার দেহে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করানো হয়, যা ডেঙ্গু ভাইরাস বহনে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে মশা কামড়ালেও ভাইরাস ছড়াবে না। তবে ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ অতি ঘনবসতিপূর্ণ, দূষিত ও অপরিকল্পিত নগরীতে উলবাকিয়া প্রযুক্তি বাস্তবায়নে নানাবিধ জটিল চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা কার্যত বাস্তবায়ন অনেক কঠিন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন প্রথমত, পরিবেশগত প্রতিকূলতা একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। ঢাকার উচ্চ তাপমাত্রা, বায়ুদূষণ এবং ভারী ধাতুর উপস্থিতি ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত উলবাকিয়া-আক্রান্ত মশাগুলোর বেঁচে থাকার সক্ষমতা কমিয়ে দেয়। গবেষণা বলছে, দূষিত পরিবেশে এই মশাগুলোর জীবনকাল প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যায়, যা তাদের প্রজনন ক্ষমতাকে ব্যাহত করে।

দ্বিতীয়ত, মশার অত্যধিক ঘনত্ব এবং বিস্তৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। ঢাকা শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে দুই লাখের বেশি মশার বসবাস, যা বিশ্বের অন্যতম উচ্চ হার। এত ঘনত্বের মধ্যে সীমিতসংখ্যক উলবাকিয়া-আক্রান্ত মশা ছেড়ে দেওয়া প্রকৃতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হতে পারে।

তৃতীয়ত, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মশার প্রজননস্থলের ব্যাপকতা এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা হ্রাস করে। ঢাকার ৬০ শতাংশ এডিস মশার প্রজননস্থল হলো বাড়ির ছাদ, নির্মাণাধীন স্থান, বহুতল ভবনের বেসমেন্টে জমা পানি, বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় পাত্রে জমে থাকা পানি, যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। 

চতুর্থত, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তোলে। ঢাকার স্থানীয় এডিস মশার জিনগত বৈচিত্র্য ল্যাবরেটরিতে তৈরি পুরুষ উলবাকিয়ায় আক্রান্ত মশার সাথে সঙ্গমে অনিচ্ছা সৃষ্টি করতে পারে, যা মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের হারকে কমিয়ে দেয়। পঞ্চমত, সামাজিক ও প্রশাসনিক বাধা যেমন স্থানীয় জনগণের অসচেতনতা, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের অভাব এই প্রযুক্তির টেকসই বাস্তবায়নে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গত বছর পুরোটা সময় ডেঙ্গুর যে ধরন আমরা দেখেছি তাতে চলতি বছর আক্রান্তরা আরও বেশি শকে যাবে। ডেঙ্গু রোগী ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইনে কোনো সমস্যা নেই। এ বছর অবস্থা আরও খারাপ হবে, কারণ আমাদের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, টারশিয়ারি লেভেলে সংক্রমণ হচ্ছে।

আমরা আমাদের মতো রোগীর সেবা দিতে সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভরা মৌসুমে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে তা এখনই ভাবাচ্ছে আমাদের। এখন আমরা নতুন করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে মশার বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। আশা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবার।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!