ঢাকা শনিবার, ২৬ জুলাই, ২০২৫

ভারতীয়দের চেয়ে দেশীয় ইউটিউবারদের আয় কেন কম?

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০২৫, ০৯:৫০ পিএম
কেন বাংলাদেশি ইউটিউবারদের আয়ের গ্রাফ ভারতীয়দের তুলনায় এত নিচে? ছবি- এআই দিয়ে ছবি তৈরি

বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত ডিজিটাল পেশা হচ্ছে ইউটিউবিং। বাংলাদেশে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ইউটিউবকে আয়, জনপ্রিয়তা ও ক্যারিয়ারের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নিচ্ছেন। তবে একটি প্রশ্ন বারবার উঠে আসে একই কনটেন্ট, একই রকম ভিউ অথচ কেন ভারতীয় ইউটিউবাররা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি আয় করেন? এর পেছনে রয়েছে কিছু মৌলিক ভ্রান্তি, গাফিলতি এবং বাস্তব চ্যালেঞ্জ। চলুন, বিশ্লেষণ করি

বিজ্ঞাপনের হার (CPM)

CPM (Cost Per Mille) অর্থাৎ প্রতি হাজার ভিউতে বিজ্ঞাপনদাতারা কত অর্থ ব্যয় করছেন, সেটিই ইউটিউবারের মূল আয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে বিজ্ঞাপনদাতাদের সংখ্যা বেশি, প্রযুক্তি খাত বেশি সক্রিয় এবং ইংরেজি ভাষায় কন্টেন্ট প্রচুর হওয়ায় CPM অনেক বেশি। ভারতের CPM গড়ে ১.৫ থেকে ৩.৫ ডলার, যেখানে বাংলাদেশে তা ০.২০ থেকে ০.৮০ ডলার।

কারণ: বাংলাদেশের লোকাল বিজ্ঞাপনদাতা কম, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর আগ্রহ কম, আর কন্টেন্ট অনেক সময় স্প্যাম বা কম মানসম্পন্ন হয়।

দর্শকদের ক্রয় ক্ষমতা

বিজ্ঞাপনদাতারা এমন দেশ ও অঞ্চলে বেশি ব্যয় করে, যেখানে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেশি। ভারতের শহরগুলোতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা অনেক, যাদের অনলাইন কেনাকাটার হার বেশি। ফলে সেখানে বিজ্ঞাপনদাতারা বেশি দামে অ্যাড চালাতে রাজি।

বাংলাদেশে এখনও অনলাইন পেমেন্ট, ই-কমার্স বা সাবস্ক্রিপশন কালচার ততটা জনপ্রিয় না হওয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারা বাজেট কম রাখে।

দর্শকদের সাথে সম্পর্ক ও ট্রাস্ট ফ্যাক্টর

ভারতীয় ইউটিউবাররা দর্শকদের সঙ্গে একটা কমিউনিটি রিলেশন তৈরি করে, নিয়মিত লাইভে আসে, কনটেন্টে রেফারেন্স দেয় এবং অনেক সময় ব্র্যান্ড থেকে পাওয়া পণ্য নিজে ব্যবহার করে দেখায়। এতে দর্শক প্রভাবিত হয়, আর ব্র্যান্ড তাদের পেছনে বেশি অর্থ ব্যয় করতে আগ্রহী হয়।

বাংলাদেশের অনেক ইউটিউবার এখনো ভিউ বাড়াতে ক্লিকবেইট, ভুল তথ্য বা ট্রেন্ডে ওঠে এমন কনটেন্ট বানায় দীর্ঘমেয়াদে যেটা আস্থার ঘাটতি তৈরি করে।

কনটেন্টের মান ও ভাষার ভিন্নতা

ইংরেজি ভাষায় কনটেন্ট বানালে বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে দর্শক পাওয়া যায়, CPM বাড়ে। ভারতের অনেক ইউটিউবার হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে বা পুরোপুরি ইংরেজিতে কনটেন্ট তৈরি করে, ফলে তাদের আয় বাড়ে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ কনটেন্ট শুধু স্থানীয় ভাষায় হয়। এই কারণে আন্তর্জাতিক ভিউয়ারশিপ আসে না, CPM কম থাকে।

বিজ্ঞাপনদাতাদের আগ্রহ ও মার্কেট সাইজ

ভারতে ইউটিউবের জন্য এক বিশাল মার্কেট তৈরি হয়েছে। ব্র্যান্ড, স্টার্টআপ ও ই-কমার্স কোম্পানিগুলো সেখানে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংয়ে প্রচুর টাকা ঢালে। ইউটিউব হয়ে উঠেছে মূলধারার বিজ্ঞাপন মাধ্যম।

বাংলাদেশে এখনও বিজ্ঞাপনদাতারা মূলত টিভি বা ফেসবুকে বেশি টাকা খরচ করে, ইউটিউবকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। তাছাড়া পণ্য ও সেবার বৈচিত্র্য কম হওয়ায় স্পন্সরশিপ ও ব্র্যান্ড কোলাবরেশনের সুযোগও কম।

নতুন ইউটিউবারদের জন্য সুযোগ কতটা?

ভারতে ইউটিউব কমিউনিটি বড় ও সহযোগিতাপূর্ণ। নতুন ইউটিউবাররা সহজেই কোলাবরেশন, শেয়ারিং ও সাপোর্ট পায়। ফলে তারা দ্রুত গ্রো করতে পারে।

বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বড় ইউটিউবাররা ছোটদের সাপোর্ট দেয় না। ‘কম্পিটিশন’ মানসিকতা বেশি, তাই কমিউনিটি বিল্ডিং দুর্বল।

অন্যান্য আয়ের উৎস

ভারতীয় ইউটিউবাররা শুধু অ্যাডসেন্সে নির্ভর করে না। তারা স্পন্সরশিপ, ব্র্যান্ড অ্যাফিলিয়েট, কোর্স/ই-বুক বিক্রি, ইভেন্ট আয়োজন, পেইড সাবস্ক্রিপশন, ইউটিউব চ্যানেল মেম্বারশিপ, মার্চেন্ডাইজ বিক্রি, লাইভ স্ট্রিমিং ডোনেশন ব্যবহার করে।

বাংলাদেশে অনেকেই শুধু মনিটাইজড ভিডিওতেই নির্ভর করে থাকে।

গুগলের নীতি ও মনিটাইজেশন চ্যালেঞ্জ

গুগলের নতুন নীতিমালায় কম মানের ভিডিও, কনটেন্ট রিপিটেশন, ভুয়া সাবস্ক্রাইবার থাকলে আয় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ভারতীয় ইউটিউবাররা সাধারণত নিয়ম মেনে কাজ করে, কপিরাইট ঝামেলা কম হয়।

বাংলাদেশে অনেকেই কনটেন্ট চুরি করে আপলোড দেয়, যার ফলে মনিটাইজেশন বন্ধ হয়ে যায় বা সাবধানবাণী আসে।

ইউটিউবে কত ভিউ হলে টাকা পাওয়া যায়?

মূলত আয় নির্ভর করে মনিটাইজেশন চালু হওয়া চ্যানেল ও বিজ্ঞাপন উপস্থিতির ওপর। গড়ে ১ হাজার ভিউতে ২০ সেন্ট থেকে ২ ডলার পর্যন্ত আয় হতে পারে।

তবে কেবল ভিউয়ের ওপর নির্ভর করলে ভুল হবে, আসল হলো সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপন চলেছে কিনা, সেটাই মূল ফ্যাক্টর।

ফেসবুক ও টিকটকের আয় তুলনা

ফেসবুকে ১ মিলিয়ন ভিউতে বাংলাদেশে গড়ে ৮ থেকে ২০ ডলার পর্যন্ত আয় হয় (কনটেন্টের ধরন ও প্ল্যাটফর্ম নির্ভর)।

টিকটকে মনিটাইজেশন এখনো বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়নি, তবে ব্র্যান্ড কোলাব ও লাইভ ডোনেশনের মাধ্যমে আয় হয়।

ইউটিউব থেকে আয় করার ১২টি পদ্ধতি: অ্যাডসেন্স (ভিউ ও বিজ্ঞাপন), স্পন্সর ভিডিও, অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং, মার্চেন্ডাইজ বিক্রি, কোর্স/ওয়েবিনার, ই-বুক বিক্রি, মেম্বারশিপ ফিচার, সুপার চ্যাট/লাইভ ডোনেশন, লাইসেন্সিং কনটেন্ট, ব্র্যান্ড কোলাবরেশন, অনলাইন কোচিং, চ্যানেল বিক্রি/সেল আউট।

সাবস্ক্রাইবার কত হলে ইউটিউবে আয় হয়?

ইউটিউব মনিটাইজেশন চালু করতে প্রয়োজন ১,০০০ সাবস্ক্রাইবার, গত ১২ মাসে ৪,০০০ ঘন্টা ওয়াচ টাইম, গুগল অ্যাডসেন্স অ্যাকাউন্ট সংযুক্ত। 

ভারতীয় ইউটিউবারদের চেয়ে বাংলাদেশের ইউটিউবাররা আয় কম করছে মূলত ভুল কৌশল, অল্প ধৈর্য, স্বল্প মানসম্পন্ন কনটেন্ট, ভাষাগত সীমাবদ্ধতা, দর্শকের ক্রয়ক্ষমতা এবং বাজারের সীমিত সুযোগ- এইসব কারণে।

তবে আশার কথা হলো, কনটেন্ট মান উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক বাজার লক্ষ্য করে কাজ এবং কমিউনিটির সহযোগিতার মাধ্যমে এই ব্যবধান অনেকটাই কমানো সম্ভব।