প্রথমে কোটা আন্দোলন। পরে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার সরকার পতনের ১ দফা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে ছাত্র-জনতার চাপে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন শেখ হাসিনা।
দ্বিতীয় বিজয় বলে খ্যাত ৬ জুলাই মানে ৫ আগস্ট তরুণদের হাত ধরে হয়েছে ক্ষমতার পালাবদল। এরপর ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার শপথ নিয়েছেন উপদেষ্টারা। এই প্রথম বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। যেখানে ২৫ থেকে শুরু করে ৮৫ বছর পর্যন্ত ব্যক্তিরা উপদেষ্টা হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন।
এই উপদেষ্টা প্যানেলে মধ্যে রয়েছেন তরুণ প্রাণের প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
বাংলাদেশে তত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের তালিকায় তরুণ প্রতিনিধি নিয়োগ ইতিহাসের প্রথম। ইচ্ছা ও উদ্যোমের জোরে ছাত্র-জনতার সফল সংযোগে বাংলাদেশের ইতিহাস গিয়েছে পাল্টে।
কে নাহিদ ইসলাম; কেইবা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া? তার আগে জানতে হবে স্বতন্ত্র নতুন ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি সম্পর্কে।
২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর সামনে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই সংগঠনটি। শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন, রাজনৈতিক ব্যক্তি, পরিসর ও সংস্কৃতি নির্মাণ, শিক্ষার্থী কল্যাণ, ছাত্র-নাগরিক রাজনীতি নির্মাণকে ও রাষ্ট্র-রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে শুরু করে সংগঠনটি। ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে আহবায়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাহিদ ইসলামকে সদস্য সচিব করে নতুন ৩১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষণা করে দলটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহবায়ক কমিটিতে আহবায়ক হিসেবে ছাত্র অধিকার পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া; সদস্য সচিব হিসেবে মো. আবু বাকের মজুমদারকে মনোনীত করে ৩৩ সদস্যের কমিটি ঘোষিত হয়। গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি সংগঠনের মূলনীতি হচ্ছে শিক্ষা, শক্তি ও মুক্তি। দায়, দরদ ও মানবিক মর্যাদা ভিত্তিক রাজনৈতিক সমাজ গঠন করাই এই দলের আদর্শ। এই দলের রাজনৈতিক অবস্থান হবে মধ্যমপন্থী ও গণতান্ত্রিক। দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন, রাজনৈতিক ব্যক্তি, পরিসর ও সংস্কৃতি নির্মাণ, শিক্ষার্থী কল্যাণ, ছাত্র-নাগরিক রাজনীতি নির্মাণ ও রাষ্ট্র-রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুর্নগঠন।
গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির নাহিদ, আসিফ-ই আজকের নতুন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের তরুণ উপদেষ্টা।
নাহিদ ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে। ১৯৯৮ সালে জন্ম নেয়া নাহিদ ইসলামের বাবা বদরুল ইসলাম জামির একজন শিক্ষক। সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। নাহিদ ইসলামের স্থায়ী ঠিকানা রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বেরাইদ ইউনিয়নে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী নাহিদ। পরে জানা যায়, তাকে গুম করে আলোচিত আয়না ঘরে ২৪ ঘণ্টার জন্য রাখা হয়। আবার ডিবির আলোচিত প্রধান হারুন রশীদের নেতৃত্বে নাহিদ-আসিফসহ ৬ সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে আন্দোলন বন্ধ করার জন্য চাপ দেয়া হয়। তারা কর্মসূচি বন্ধের চিঠি পাঠ করেন। কিন্তু ভিডিও বার্তায় তাদের পাঠানো কোড নাম্বার ধরে আন্দোলনকে নতুন গতি দেয় পরবর্তী ধাপের সমন্বয়কারীরা। চাপে পড়ে নাহিদ-আসিফদের ছেড়ে দেয় প্রশাসন। মৃত্যুর হাত থেকে ফেরত আসা নাহিদ ইসলাম নতুন বাংলাদেশ গড়তে অন্য আরেক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে হয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা। শপথ নেয়ার পর নাহিদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা বলেছিলাম যে রাষ্ট্র পূর্নগঠন ও সংস্কারের কাজ আমাদের করতে হবে। পুরো বাংলাদেশকে নতুন করে সাজাতে হবে। ছাত্রদের নেতৃত্বে সরকারের ভিতরে যেমন আমাদের প্রতিনিধি থাকবে। রাজপথেও আমাদের ছাত্রদের উপস্থিতি থাকবে। সামগ্রিকভাবে একটি নতুন বাংলাদেশ তৈরিতে নিজেদেরকে আমরা কাজে লাগাব।
দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে একদিন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ অনেক দিন ধরে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। মানুষের সেই ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে সরকার কাজ করবে। তার আগে নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন; না হলে মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হবে।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। ভর্তি হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে। নাখালপাড়া হোসাইন আলী হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। বাবার নাম মো. বিল্লাল হোসেন। আসিফ মাহমুদের স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলায়।
আসিফ মাহমুদ বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি। সংগঠনটি বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গনে মো. তারেক রহমানের সমন্বয়ে আলামিন, রাসেল, রাজু, দীন মোহাম্মাদ, সাকিব চৌধুরী, সুমন কবিরের নেতৃত্বে শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনটির প্রথম কর্মসূচি ছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় জাদুঘরের সামনে প্রায় ২০০০ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি। এই সংগঠনে আসিফ বেশ ভালো ভূমিকা পালন করছেন।
বর্তমানে উপদেষ্টা হিসেবে নতুন দায়িত্ব পালন করবেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। শপথ গ্রহণের পর গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, এই সরকার বাংলাদেশকে একটি নতুন বাংলাদেশ রূপে আবির্ভূত করতে সহযোগিতা করতে পারবে। এই সরকারের যেমন নতুনত্ব রয়েছে; এই সরকার একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারবে।’
শিক্ষা ব্যবস্থার নতুনত্ব নিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কমিটমেন্টগুলো ছিল; যিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবেন-তার সাথে বসে কথা বলে সেই কমিটমেন্টগুলো সর্বপ্রথম আমরা পূরণ করবো। এ ছাড়া আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। যিনি উপদেষ্টামন্ডলী থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরু দায়িত্ব পাবেন; তার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে দাবি ও কমিটমেন্টগুলো পূরণে দ্রুত সচেষ্ট হব।
হল কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি একটি পলিসিগত বিষয়। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একটি রিসার্চ টিম করে কাঠামোগত ও ভালো সংস্কারের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। আমরা আমাদের ৯ দফা দাবিতে উল্লেখ করেছিলাম লেজুড় ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে।
আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন স্টুডেন্ট অ্যাক্টিভিজমের সাথে জড়িত থাকার ফলে লেজুড় ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির খারাপ দিক আমরা দেখেছি। আমাদের আন্দোলনে ছাত্রলীগ তার জাতীয় সংগঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এসে হামলা করে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সেই লেজুড় ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি আমরা ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ চেয়েছিলাম। বর্তমানে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা এমন পলিসি নেয়ার চেষ্টা করব যেন ভালো ভাবে গবেষণা করার মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিকে চূড়ান্ত সমাধানের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টারা হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষক এবং লেখক, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. আসিফ নজরুল, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক, আইনজীবী ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদিলুর রহমান খান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবীদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা, বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায়, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর আ.ফ.ম খালিদ হাসান, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম, বেসরকারি সংস্থা ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ ও মুক্তিযুদ্ধের নৌ কমান্ডো ফারুক ই আজম বীর প্রতীক এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্তির পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে দেশের পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
৬ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ৫ আগস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর হাতে দেশ পরিচালনার ভার আসে। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের। আলোচনায় বসা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সাথে। পাশাপাশি আলোচনা করা হয় দেশের সুশীল সমাজ এবং আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে। সবাই অন্তর্বর্তী সরকারের সম্ভাব্য উপদেষ্টার তালিকা প্রদান করেন। অনেক বিচার-বিশ্লেষণের পর গঠিত হয় ১৭ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি; যাদের হাতে নতুন বাংলাদেশ গড়ার চ্যালেঞ্জ।