ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহ-সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। পরবর্তীতে এই ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলে সামনে থেকে সাহসী নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন মুসাদ্দিক।
নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এক বিদেশি দূতাবাসে আশ্রয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন মুসাদ্দিক। কিন্তু তখন নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে দেশ ও জাতির নিরাপত্তার কথা ভেবেছিলেন তিনি। এ কারণে দূতাবাসে আশ্রয়ের প্রস্তাবকে ফিরিয়ে দিয়ে রাজপথকেই বেছে নেন মুসাদ্দিক। সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ সব কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়াও তুলে ধরেছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তার বাস্তব অভিজ্ঞতা।
বাসস : ২০২৪ সালের ৫ জুন যখন আনুষ্ঠানিকভাবে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তখন এই আন্দোলন নিয়ে আপনি কি ভেবেছিলেন?
মুসাদ্দিক : ৫ জুন যখন শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নামতে শুরু করে, তখন আমার মনে হয়েছিল যে এটা একটা বিশাল কিছু হতে যাচ্ছে। এর আগেও কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল, কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন ছিল। সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে কোটা পুনর্বহাল করার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ছিল এই আন্দোলন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করতাম যে কোটা বৈষম্যমূলক এবং মেধাবীদের জন্য এটি একটি বড় বাধা। তাই যখন শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামল, আমি তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের পর এত বড় স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র সমাবেশ আর হয়নি। তাই তখনই বুঝেছিলাম যে বড় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
বাসস : ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন সম্পর্কে কিভাবে জেনেছিলেন, ওই সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
মুসাদ্দিক : ২০১৮ সালে যখন কোটার প্রতিবাদে আন্দোলন চলে আমি তখন ক্লাস টেনে পড়তাম। ওই সময় আমি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে স্কুল থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। পরে কোটার আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিলাম। ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট সায়েন্সল্যাব থেকে জিগাতলা যাওয়ার পথে আমাদের মিছিলে পুলিশ টিয়ারশেল ছুঁড়েছিল এবং ছাত্রলীগও হামলা করেছিল। এর পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম। এরপর ২০১৯ সালে আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদেও সক্রিয় ছিলাম। যৌক্তিক, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমি সবসময় অংশ নিয়েছিলাম।
বাসস : আন্দোলনের শুরুর দিকে কি কি করেছিলেন অথবা শুরুর দিনগুলো কেমন ছিল?
মুসাদ্দিক : আসলে এবারের আন্দোলনটা আমাদের কোনও জোরপূর্বক বা সাংগঠনিক ক্ষমতার মাধ্যমে সংগঠিত করতে হয়নি। কারণ, ফ্যাসিবাদী কাঠামো এতটাই শক্তভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদী সরকারের যে আক্রমণ, তা সরাসরি ছিল দেশের সামগ্রিক ছাত্র সমাজের ওপর। শিক্ষার্থীদের অধিকার যখন এতটা প্রকাশ্যভাবে লঙ্ঘিত হয়, তখন আলাদা করে তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিতে হয়নি। তারা নিজেরাই বুঝে যায়-এটা সবার লড়াই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন হলগুলোতে ঠিকমত ঘুমাতে পারত না। সরকারের ছাত্র সংগঠন শিক্ষার্থীদের আধুনিক দাসের মতো ব্যবহার করতো। প্রতিনিয়ত সকাল-বিকেল নানা প্রোগ্রাম এবং রাতে গেস্ট রুমে নির্যাতন চালাত। এই যে নির্যাতন আর নিপীড়ন, এসব শিক্ষার্থীরা মুখ বুজে সহ্য করছিল।
তাদের সহ্য করার মূল উদ্দেশ্য ছিল-শান্তিপূর্ণভাবে পড়াশোনা শেষ করে একটা ভালো চাকরি ম্যানেজ করা। বিসিএস অথবা অন্য কোনো সরকারি চাকর-যেখানে একটা স্থিতিশীল এবং সম্মানজনক জীবন পাওয়া যাবে। এই স্বপ্ন নিয়েই তারা ৫-৬ বছর ধরে এক প্রকার ‘জাহান্নামের’ মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু, এই স্বপ্নের শেষ ধাপে-যেখানে একজন শিক্ষার্থী চাকরির জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল-সেই জায়গায়ই সরকার আঘাত হানল। তখন আর শিক্ষার্থীদের পিছু হটার কোনো সুযোগ ছিল না। তখন তারা চূড়ান্তভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গেল।
আমরা শুধু প্রয়োজনীয় একটি ডাক দিয়েছিলাম। সেই ডাকে শিক্ষার্থীরা পঙ্গপালের মতো ছুটে এসে আমাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকল। আন্দোলনের শুরুর দিকে আমরা কয়েকজন অর্গানাইজার ছিলাম, তখন কোনো কমিটি ছিল না। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মসূচি ঠিক করতাম। প্রথমদিকে, আমরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলাম। ফেসবুক, এক্স (টুইটার) এবং বিভিন্ন মেসেজিং গ্রুপে আমরা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিলাম। তখনো বড় আকারের কোনো কর্মসূচির ঘোষণা আসেনি, কিন্তু ছোট ছোট প্রতিবাদ চলছিল। আমরা এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা যেন নিভে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখছিলাম। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এবং তাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে জনমত তৈরি করাই ছিল আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। কুরবানি ঈদের ছুটি চলে আসায় আমরা ৯ জুন একটি মানববন্ধন করে ৩০ জুন পর্যন্ত একটা আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম যাতে এর মধ্যে আমাদের দাবি মেনে নেয়া হয়।
ঈদের সময় বাসায় থাকলেও অনলাইনে আন্দোলনের প্রচারণা অব্যাহত রাখি। আন্দোলন থামিয়ে রাখিনি, বরং ছোট ছোট ভিডিও, তথ্যভিত্তিক পোস্ট, আন্দোলনের যৌক্তিকতা ইত্যাদি তুলে ধরতে থাকি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যেন ছুটির পর শিক্ষার্থীরা আবার জেগে উঠে। এবং তাই হয়েছিল।
বাসস : ১-১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে লাগাতার বিভিন্ন কর্মসূচিতে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
মুসাদ্দিক : জুলাইয়ের শুরু থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত আমি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘোষিত কর্মসূচি ভালভাবে বাস্তবায়ন করতে কাজ করতাম। তারপর সন্ধ্যায় ঘরে গিয়ে অনলাইনে প্রচারণা চালাতাম। প্রতিদিন সকাল বেলা আমি ক্যাম্পাসে এসে হলগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে আমাদের কর্মসূচীতে আসার জন্য বলতাম। এ জন্য কখনোবা মাইকের মাধ্যমে কখনোবা হলের রিডিং রুমগুলোতে গিয়ে জনসংযোগ করতাম। এসব কারণে আমাকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
প্রথম ১০-১২ দিন আন্দোলন অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। তবে, এক্ষেত্রে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে হুমকি-ধামকি ছিল নিয়মিত। ৩ বা ৪ জুলাই যখন আমরা হল এবং রিডিং রুমগুলোতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলাম, তখন ছাত্রলীগ আমাদের ওপর নজর রাখছিল এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে হামলার ঘটনাও ঘটেছিল। বিশেষ করে, এফআর হলে গণসংযোগের সময় ছাত্রলীগের ৪-৫ জন আমাদের ওপর চড়াও হয়, গালিগালাজ করে, মাইক ও ক্যামেরা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে আমরা ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেই।
কিছু কিছু সমস্যা থাকলেও আন্দোলন স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল। কিন্তু ১১ জুলাই থেকে সমস্যা দেখা দেয়। ওইদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হামলা হয়। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়। এদের মধ্যে প্রায় ৯ জন শিক্ষার্থীকে আইসিইউতে ভর্তি করতে হয়। একই দিনে ছাত্রলীগ মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেয় এবং সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে মিছিল বের করার চেষ্টা করা হয়। কলাভবনের সামনে পানি জমে থাকায় মিছিলকে মধুর ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে যেতে হয়, যার ফলে ছাত্রলীগের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়। উভয় পক্ষ থেকেই উত্তপ্ত স্লোগান দেওয়া হয়। পরে সিনিয়ররা পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করেন যাতে সংঘাত এড়ানো যায়।
এরপর মিছিলটি শাহবাগের দিকে এলে পুলিশ একটি ব্যারিকেড দেয়, যা ভাঙা আবশ্যক ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য। ব্যারিকেড ভাঙতে গিয়ে পুলিশের সাথে ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন আহত হয়।
১১ জুলাইয়ের ঘটনার পর ১২ ও ১৩ জুলাই তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল। ছাত্রলীগ যদিও সংঘাতের দিকে যেতে চাইছিল, কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদন (৫ জুলাই) অনুযায়ী, যদি ছাত্রলীগ আন্দোলনে বাধা দেয়, তবে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ কারণে পরিস্থিতি অনেকটাই শিথিল ছিল। অন্যদিকে ১০ জুলাই হাইকোর্টের দুই মাসের স্থিতাবস্থা রায়ের পর সরকার ধীরে ধীরে মারমুখী হয়ে ওঠে।
১৪ জুলাই সকালে শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয় আমাদের পক্ষ থেকে। যদিও পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙতে গিয়ে কয়েকবার হামলার শিকার হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তবে পুলিশ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হামলা করেনি। ওইদিন রাতের বেলা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তেব্যের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে রাস্তায় নেমে পড়ে । তখন আমি আমার মোহাম্মদপুরের বাসায় ছিলাম এবং ছাত্রলীগের গতিবিধি, বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে আন্দোলনকারীদের জানাচ্ছিলাম। পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে পারে এমন প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও বন্ধুদের বলেছিলাম।
বাসস : ১৫ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কি ঘটেছিল?
মুসাদ্দিক : ১৪ জুলাই রাতে কোপা আমেরিকার ফাইনাল ম্যাচ থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী খেলা দেখে সকালের দিকে ঘুমিয়েছিল। ওইদিন আমাদের কর্মসূচি ছিল দুপুর ১২টায়। তবে, ছাত্রলীগ পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে বিকেল তিনটায়। এই পরিস্থিতিতে আমি, মাহিন সরকার এবং আরও ৪-৫ জন একটি রিকশা নিয়ে হলগুলোতে মাইকিং শুরু করি। আমাদের মূল দাবি ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে এবং কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নিতে হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলাম।
মাইকিং করার সময় জসিম উদ্দিন হল এবং মুজিব হলে ছাত্রলীগের কর্মীরা আমার ছবি তুলছিল এবং বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছিল। বিজয় ৭১ হলে তখনও কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু যখন আমরা জহুরুল হক হলে প্রবেশ করি, তখন দোতলা থেকে কাচের বোতল ছুড়ে মারা হয়। এই অপ্রত্যাশিত হামলার পর আমরা সেখান থেকে সরে আসি।
আনুমানিক দূপুর ১২ টার দিকে আমরা আমাদের কর্মসূচি শুরু করতে চাইলে আমরা শুনতে পাই যে বিজয় একাত্তর হলের হল সংসদ কক্ষে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখা হয়েছে। এই খবর পেয়ে আমি, আবু বকর মজুমদার, আব্দুল্লাহ সালেহ অয়ন এবং আরও কয়েকজন মিলে একটি মাইক নিয়ে ৫০-৬০ জনের একটি দল স্লোগান দিতে দিতে হলপাড়ায় প্রবেশ করি। প্রথমে আমরা মুজিব হলে যাই এবং শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণভাবে আহ্বান জানাই, "যারা আটকে আছেন, আমাদের সাথে আসুন, আমরা আপনাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাব।" আমাদের মিছিল দেখে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্রলীগের বাধা ভেঙে বেরিয়ে আসে। জিয়া হলেও একই ঘটনা ঘটে।
তবে, বিজয় একাত্তর হলের সামনে যখন আমরা মাইকিং করছিলাম এবং শিক্ষার্থীদের আটকা থাকার খবর জানিয়ে তাদের সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ করে পাঁচ বা ছয়তলা থেকে ১৫-২০ জন বড় বড় ইট, ফুলের টব এবং অন্যান্য ভারী জিনিসপত্র ছুড়ে মারতে শুরু করে। ছাত্রলীগের কর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়ে এই হামলা চালায়। এতে একজনের হাতে ও একজনের মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে।
আমার হাতে মাইক থাকায় আমি স্লোগান দিচ্ছিলাম, "ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ইট মারছে, হামলা করছে, এরা শিক্ষার্থী বিরোধী সন্ত্রাসী, এদেরকে ধরে নিয়ে আসো!" ছাত্রলীগ তখন আমাকে লক্ষ্য করে মাইক বরাবর অনেকগুলো ইট ছুড়ে মারে। একটি বড় ইট আমার পাশ দিয়ে চলে যায়।
শিক্ষার্থীদের কয়েকজন ভিতরে প্রবেশ করে ছাত্রলীগের কয়েকজনকে ধরেও নিয়ে আসে। এই সময়ের মধ্যে আশেপাশের হলগুলোতে ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের বিকেল তিনটার কর্মসূচি নিয়ে সংগঠিত হচ্ছিল। তারা আগে থেকেই লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রস্তুত ছিল, কারণ তারা জানত যে আমরা প্রতিদিন হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের ডাকার জন্য মিছিল নিয়ে যাই। তাই তারা আমাদের আসার অপেক্ষায় ছিল এবং আমরা আসা মাত্রই হামলা করে। আমরা খালি হাতে ছিলাম এবং আমাদের সাথে লোকবলও কম ছিল।
ছাত্রলীগ কর্মীরা ছুরি, চাপাতি, রড ইত্যাদি নিয়ে প্রথমে বিজয় হল থেকে হামলা শুরু করে। ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক শান্ত হকি স্টিক ও স্টাম্প নিয়ে জসিম উদ্দিন হলের পুকুরের কাছে এসে দাঁড়ায় এবং হামলার নির্দেশনা দেয়। এসময় জসিম উদ্দিন হলের ভেতর থেকেও ইট মারা হচ্ছিল।
শিক্ষার্থীরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল, কারণ এমন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। আমরা একবার পিছে আসি, আবার এগিয়ে যাই। ইট ছোড়াছুড়ি চলছিল এবং তাদের হাতে লাঠি ও ছুরি ছিল। আমি শিক্ষার্থীদের সতর্ক করার চেষ্টা করছিলাম যে, ‘ওরা অল্প কয়েকজন সন্ত্রাসী, ওরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না। আমাদের আরও শিক্ষার্থীরা আসছে। সুতরাং ওরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না, আপনারা ওদেরকে ধরে নিয়ে আসুন।’ আমার নির্দেশনার পর ছাত্রলীগ কয়েকবার হলের ভেতর ঢুকে যায় এবং আমরা তাদের ধাওয়া করি।
তবে, একপর্যায়ে তারা পুরোপুরি সংগঠিত হয়ে যায়। আমাদের হাতে লাঠিসোঁটা না থাকায় আমরা পিছু হটি। এসময় আমাদের কয়েকজন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের হাতে গুরুতর আহত এবং রক্তাক্ত হয়। আমরা প্রথমে মলচত্বরে আশ্রয় নিই।
ঠিক এমন সময় মধুর ক্যান্টিন থেকে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হয় এবং হামলা শুরু করে। তখন আমরা ভিসির চত্বরে, ভিসির বাসভবনের সামনে আশ্রয় নিই। আমরা ভিসির বাসভবনের দরজায় নক করে আশ্রয় চাই এবং বলি যে ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা করছে।
আমরা যখন ভিসির বাসভবনের সামনে আশ্রয় নিই এবং বলি যে, ‘আমাদেরকে আশ্রয় দিন, আপনার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সামনে আমাদেরকে রক্তাক্ত করা হয়েছে, আপনারা কী করছেন?’ ঠিক এমন সময় মধুর ক্যান্টিন থেকে বন্দুক, রাইফেল, ছুরি, চাপাতিসহ অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে মহানগর থেকে আসা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা শুরু করে। সেদিন আমাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না, কারণ আগের দিন রাতে কোপা আমেরিকার ফাইনাল খেলা দেখায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী তখনও হলে ঘুমাচ্ছিল।
ছাত্রলীগের হামলার মুখে আমরা দৌড়ে শহীদ মিনারের দিকে চলে যাই। এসময় ঢাকা কলেজের এক ছেলের হাতে আঘাত লাগে। আমি তাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে প্রবেশ করি। সেখানে গিয়ে দেখি, অনেক শিক্ষার্থী রক্তাক্ত অবস্থায় আসছে, কিছুক্ষণ পরপর ৪-৫ জন করে নিয়ে আসা হচ্ছে। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল না। সেসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা, যারা আমাদের সাথে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, তারা প্রাথমিক চিকিৎসায় সহায়তা করে।
আমি এবং আরও কয়েকজন পরে প্রশাসনিক ভবনে গিয়ে হাসপাতালের পরিচালককে চাপ দিই যে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না এবং ডাক্তার নেই। আমাদের চাপের মুখে ডাক্তারদের সংখ্যা বাড়ানো হয় এবং অনেকের প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু হয়। অনেকের মাথায় রামদা দিয়ে কোপানো হয়েছিল এবং ইটের আঘাতে অনেকে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল।
একপর্যায়ে ছাত্রলীগ হামলা করতে করতে মেডিকেলের জরুরি গেটে অবস্থান নেয়, আর আমি তখন ভেতরে কাজ করছিলাম। শুরুতে মেডিকেলে আমার সাথে কয়েকজন থাকলেও কিছুক্ষণ পর তারা চলে যায়। এমন সময় ছাত্রলীগ হাসপাতালের ভেতরে হামলা শুরু করে। তখন আমরা জরুরি ওয়ার্ডে আশ্রয় নিই। আমাদেরকে লক্ষ্য করে ধাওয়া দেওয়া হয়। আমরা যখন ভেতরে আশ্রয় নিই, তখন অল্প কয়েকজন আনসার কর্মী তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল।
বিকেল তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে আমরা ভেতরে থাকা অবস্থায় প্রায় ১০-১৫ বার হামলা হয়। আমি প্রায় রাত ১০টা পর্যন্ত হাসপাতালের ভেতরে আটকে ছিলাম। আহত শিক্ষার্থীরা জরুরি বিভাগের ডান পাশের ২১৫ নম্বর রুমে (যেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়) ছিল, সেখানেও ঢুকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়। একপর্যায়ে তারা বলে যে ভেতরে অনেক শিক্ষার্থী আশ্রয় নিয়েছে, তাদের খুঁজে বের করবে এবং পুলিশে দেবে। তারা প্রত্যেক রুমে সার্চ করারও চেষ্টা করছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে, মূলত মুহসিন হল ছাত্রলীগের ইউনিট মেডিকেলের জরুরি গেট নিয়ন্ত্রণ করছিল।
একপর্যায়ে আমি মাস্ক পরে, মেডিকেলের কিট মাথায় ও গায়ে জড়িয়ে ডাক্তারদের সাথে পেছন দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসি। মেডিকেল থেকে রাত ১০টায় বের হওয়ার সময় আমার সাথে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দুইজন জুনিয়র এবং একজন ফ্রেন্স ল্যাংগুয়েজ ডিপার্টমেন্টের বন্ধু ছিল, যার বাসা ফার্মগেটের তেজগাঁওতে। তার মা মূলত একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছিলেন আমাদের উদ্ধার করার জন্য। অ্যাম্বুলেন্স কোনো কারণে ঢুকতে না পারায়, পরে ওই আন্টি আমাদের রোগীর মতো করে সিএনজিতে করে হাসপাতাল থেকে বের করে আনেন ঢাকা মেডিকেলের পেছনের গেট দিয়ে।
বাসস : ১৬ এবং ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িতসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। আপনার এই দুই দিনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
মুসাদ্দিক : বাসায় ফিরে আমি আমার মোবাইল (চার্চ না থাকায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল) সচল করি এবং যারা আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য কল বা মেসেজ করেছিল তাদেরকে রিপ্লাই দিই। একই সাথে পরের দিনের কর্মসূচি নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে শাহবাগে একটি সমাবেশ করা হবে। ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা সরকারি কলেজ, ঢাকা কলেজ, তিতুমীর কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বাংলা কলেজসহ আশেপাশের ক্যাম্পাসগুলোর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে সমন্বয় করা হয় শাহবাগে সমাবেশের জন্য।
তবে ১৫ জুলাই মূলত বিজ্ঞান বিভাগের তিনটি হল ( শহীদুল্লাহ্ হল, অমর একুশে হল এবং ফজলুল হক মুসলীম হল) ছাত্রলীগ মুক্ত হয় এবং এই হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিল। তাই পরদিন সকালে (১৬ জুলাই) ১০টার দিকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়। যেহেতু বিজ্ঞানের হলগুলো থেকে শহীদ মিনারের দূরত্ব কম এবং কৌশলগতভাবে এটি আরও ভালো জায়গা, তাই শাহবাগের পরিবর্তে শহীদ মিনারে সমাবেশ স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ, ছাত্রলীগ মূলত মধুর ক্যান্টিন, রাজু ভাস্কর্য বা টিএসসি কেন্দ্রিক অবস্থান নেবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। যদি শহীদ মিনারে অবস্থান নেওয়া যায় এবং তিনটি হলের সমর্থন পাওয়া যায়, তাহলে সমাবেশ ভালোভাবে করা সম্ভব হবে বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
১৬ জুলাই সকাল ১১টার দিকে আমি মোহাম্মদপুর থেকে শহীদ মিনারে আসি। এসময় সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ঢাকা কলেজ এবং আশেপাশের কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিল। তাদের সংগঠিত করার জন্য আমি কিছু স্লোগানসহ তাদের সাথে আন্দোলনে অংশ নেই।
আগের দিন খালি হাতে হামলার শিকার হওয়ায় এবার আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। তাই আমি এবং আমার ৪-৫ জন বন্ধু ও জুনিয়র মিলে জিআই পাইপ কেনার সিদ্ধান্ত নেই। আজিমপুর, লালবাগ এলাকার জিআই পাইপের বিভিন্ন দোকান থেকে কয়েকশ’ ৪ ফুটের জিআই পাইপ সংগ্রহ করা হয়। দুপুর ২টার দিকে একটি সিএনজি ভরে পাইপগুলো শহীদ মিনারে আনা হয় । লাঠিসোঁটা সংগ্রহের দায়িত্ব আরেকজনকে দেওয়া হয়, যিনি পরে সিএনজি করে অনেকগুলো স্ট্যাম্প নিয়ে আসেন এবং সবার হাতে স্ট্যাম্প পৌঁছে যায়। শিক্ষার্থীরা তখন সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে। সায়েন্সের তিনটি হল থেকেও শিক্ষার্থীরা বেরিয়ে আসে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে ছোট ছোট মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকে।
শিক্ষার্থীরা তখন শহীদ মিনারের বিভিন্ন প্রবেশমুখগুলোতে অবস্থান নেয়। একটি দল রাসেল টাওয়ারের দিকে, আরেকটি বকশীবাজারের দিক দিয়ে জগন্নাথ হলের দিকে এবং আরেকটি চানখাঁরপুলের মোড়ে অবস্থান নেয়। এ দিন পুলিশ সরাসরি গুলি চালায়নি। মূলত হাজী সেলিমের বাহিনী চানখাঁরপুলের মোড়ে গুলি চালায়, সেখানে কয়েকজনের শরীরে গুলি লাগে।
শহীদ মিনারে প্রাথমিক বক্তব্য ও সমাবেশ শেষ হওয়ার পর মিছিল শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের মূল লক্ষ্য ছিল ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসমুক্ত এবং হলগুলো ছাত্রলীগ মুক্ত করা। প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার শিক্ষার্থী সমাবেশে অংশ নেয়। শিবির, ছাত্রদল এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠন সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিয়ে লাঠিসোঁটা সহকারে প্রস্তুত হয়ে আসে।
সন্ধ্যারদিকে আবু সাইদসহ ছয়জন শহীদ হওয়ার খবর আমাদের সবার কাছে পৌঁছে যায়। এই সংবাদ পাওয়ার পর সবাই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা মনে করে, আগের দিন মার খেয়েও তারা হলে ঢুকতে পারেনি, আজ শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে সমাবেশে এসেছে। যদি হলগুলো দখলমুক্ত না হয়, তাহলে তারা আর হলে থাকতে পারবে না, কারণ ছাত্রলীগ হুমকি দিয়েছিল যে যারা হলে ঢুকবে, তাদের নির্যাতন করা হবে।
শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলেও, যারা নেতৃত্বে ছিল তারা কোনো শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয় এবং অনেকে তাদের লিয়াজোঁ করার অভিযোগও তোলে। সেদিন দোয়েল চত্বর দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। একপর্যায়ে শহীদ মিনারে এসে শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করবে। শহীদ মিনার থেকে তারা ভিসির বাসভবন পর্যন্ত আসে। সেখানে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল।
রাত ৯টার দিকে ভিসি চত্বর ভৌতিক আকার ধারণ করে। আশেপাশের সব লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুলিশ তিন ধাপে অবস্থান নেয়। প্রথমে পুলিশ, এরপর র্যাব এবং পেছনে বিজিবি।
নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে একপর্যায়ে সবাই একে একে সেখান থেকে সরে যায়। এই দিন ক্যাম্পাসের আশেপাশে যতগুলো রাস্তা ছিল এবং যত জায়গায় মিছিল হয়েছিল, সব জায়গায় পুলিশ এবং ছাত্রলীগ হামলা চালায়। শেরেবাংলা নগর, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, সায়েন্স ল্যাবরেটরি-সব জায়গাতেই হামলা হয়। যারা আন্দোলন থেকে ফিরছিল, তাদের সবাইকে চেকপোস্টে থামিয়ে মারধর করা হয় এবং মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়।
১৬ জুলাই সারাদেশে সংগঠিত হামলা ও ৬ জনের শহীদ হওয়ার ঘটনায় ওই রাতে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেই। আমরা ১৭ জুলাই দুপুর ২টায় রাজু ভাস্কর্যে নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে গায়েবানা জানাজার ঘোষণা দেই। ১৬ তারিখ রাতেই এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
তবে ১৬ তারিখ সারাদিনের ঘটনায় চারদিকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। হলের শিক্ষার্থী যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলে ফিরে গিয়েছিল, তারা ছাত্রলীগের হুমকি উপেক্ষা করে সরাসরি বিদ্রোহ শুরু করে। ১৫ ও ১৬ জুলাইয়ের হামলায় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে ফজিলতুন্নেসা মুজিব হল এবং বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল ১৬ তারিখ রাতেই ছাত্রলীগ মুক্ত হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা এই হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়।
১৬ তারিখ রাত ১২টা থেকে ১টার দিকে কবি সুফিয়া কামাল হল এবং রোকেয়া হলও ছাত্রলীগ মুক্ত হয়। রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকাসহ হামলার সাথে জড়িত ছাত্রলীগের অন্যান্য কর্মীদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বের করে দেয়। একই রাতে হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলও বিদ্রোহ করে এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এবং ফজরের পরপরই মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলও ছাত্রলীগ মুক্ত হয়। এরপর মুজিব হল, জসিম উদ্দিন হল, সূর্যসেন হল এবং বিজয় একাত্তর হলও ক্রমান্বয়ে ছাত্রলীগ মুক্ত হয়।
হলগুলো দখল নেওয়ার পর আমি ১৭ তারিখ সকালে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ভেতরে অবস্থান করছিলাম। হলগুলো মুক্ত হওয়ার পর জিয়া হলে একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। পরে আমি এবং আরও কয়েকজন মিলে প্রত্যেকটি হলে যাই এবং শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করি যে কেউ যেন হল ছেড়ে না যায়।
এদিন দুপুর ২টায় রাজু ভাস্কর্যে গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ছিল। দুপুর ১টা বা তার কিছু আগে যখন শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে শুরু করে, তখন পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং অনেককে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আখতার হোসেনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় সার্জিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাসহ কয়েকজন বিজ্ঞানের হল থেকে একটি মিছিল নিয়ে এসে ভিসি বিরোধী স্লোগান এবং ‘হল বন্ধ করা চলবে না’ নামের স্লোগান দেয়। এরপর ছাত্র ইউনিয়নের একটি মিছিল এসে ‘ভিসি সন্ত্রাসীদের পাহারা দিচ্ছে, ক্যাম্পাস বন্ধ করা চলবে না’ স্লোগান দেয়।
একই সময়ে, যখন আমরা জানতে পারি যে ক্যাম্পাস বন্ধের ঘোষণা আসবে, তখন আমরা সিনেট ভবনে সিন্ডিকেট মিটিং ঘেরাও করার ঘোষণা দেই। আমাদের দাবি ছিল, ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাস এলাকায় নিষিদ্ধ করার আইন পাস করতে হবে এবং ক্যাম্পাস বন্ধ করা যাবে না। এই ঘোষণার সাথে সাথেই প্রশাসন বিষয়টি জানতে পারে এবং ভিসি ও অন্যান্য কর্মকর্তা ভিসির বাসভবনে চলে আসেন।
তখন আমরা সবাই ভিসির বাসভবনের সামনে জড়ো হই এবং ভিসির বাসবভনের গেটে আঘাত করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে গেট খোলার দাবি জানাই, অন্যথায় গেট ভেঙে ফেলার হুমকি দেই।
প্রথমে পুলিশের একটি দল এসে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়। এরপর প্রায় ১০০ র্যাব সদস্য এসে দুই স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে। পরে তিন-চার গাড়ি বিজিবি এসে অস্ত্রসহ অবস্থান নেয়। এই ত্রি-স্তরীয় নিরাপত্তা বলয়ের কারণে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই ভিসির বাসভবনে প্রবেশ করতে পারেনি।
রাজু ভাস্কর্যে গায়েবানা জানাজা করা সম্ভব না হওয়ায়, আমি প্রস্তাব দেই যে যেহেতু শিক্ষার্থীরা হলগুলোতে অবস্থান করছে এবং নেটওয়ার্কও দুর্বল (টুজি/থ্রিজি), তাই হলগুলোতে গায়েবানা জানাজা পড়া যেতে পারে। কিন্তু হলগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী যেকোনো মূল্যে গায়েবানা জানাজা পড়া হবে।
এসময় ছাত্র ইউনিয়ন, বামপন্থী সংগঠনগুলো এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা সেখানে জড়ো হয়। আমি ঘোষণা দেই, গায়েবানা জানাজা ভিসি চত্বরেই পড়া হবে, যতজনই থাকুক না কেন। জাহেদুল হক নামের এক ব্যক্তি, যিনি শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তিনি এসে কফিন আনার কথা বলেন। জাহেদুল হকসহ ৩০-৪০ জন ব্যক্তি মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে কফিন নিয়ে আসেন। আরও একটি কফিন লাশবাহী গাড়িতে করে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে আনা হয়। মোট ছয়টি কফিন আনা হয়, যা গায়েবানা জানাজার জন্য এক আবেগঘন পরিস্থিতি তৈরি করে।
গায়েবানা জানাজা শেষ হওয়ার পর কফিন মিছিল শুরু হয়। কফিন মিছিল যখন গুরুদুয়ারা নানকশাহী পার হয়, তখন পুলিশ রাজু ভাস্কর্য ও ভিসি চত্বর দুই দিক থেকে সাউন্ড গ্রেনেড এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে হামলা শুরু করে। এতে আমরা সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। মিছিলের একটি অংশ কফিন নিয়ে মুক্তি গণতন্ত্র তোরণের দিক দিয়ে বের হয়ে যায় এবং আরেকটি অংশ লাইব্রেরির পাশ দিয়ে দেয়াল টপকে মধুর ক্যান্টিনের দিক দিয়ে মলচত্বরে ফিরে আসে।
টিয়ার গ্যাসের কারণে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না এবং দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন ছিল। পুরো ক্যাম্পাস টিয়ার গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল এবং আমাদের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছিল। মলচত্বরে পুনরায় শিক্ষার্থীদের একত্রিত করার চেষ্টা করি। এসময় পুলিশ আবার ভিসির চত্বর থেকে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে করতে মলচত্বর হয়ে আমাদেরকে হলের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।
ছাত্রলীগ হলগুলো থেকে বিতাড়িত হয়ে শাহবাগে অবস্থান নেয়। একই সময়ে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি গণহত্যার গুজব ছড়াতে শুরু করে, বিশেষ করে সন্ধ্যার পর লাইট নিভিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা চালানো হবে বলে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। এই গুজবের কারণে পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে যেতে শুরু করে। অনেকেই হল ফাঁকা করে দেয়। তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই যারা পারি হল থাকবো, যা হওয়ার হবে। কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে চাপের কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি।
বাসস : ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কিভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
মুসাদ্দিক : ১৭ জুলাই রাতে 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তখন আমি অনেকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হইনি। পরে আমি মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি (২৭ নম্বর) এলাকার আন্দোলনকারীদের সাথে যোগাযোগ করি। ইসমাইল পাটোয়ারী এবং রাকিবের মতো কিছু স্বতন্ত্র আন্দোলনকারীকে আমি সংগঠিত করতে পারি। সিদ্ধান্ত হয় যে ১৮ জুলাই বেলা ১১টা থেকে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের 'রাপা প্লাজার' সামনে আমরা অবস্থান করবো।
আমি নিজে সেখানে গিয়ে সকলকে একত্রিত করি এবং সকাল ১১ টা থেকে সেখানে অবস্থান নিই। সেখানে আন্দোলন চলাকালে আমার চোখের সামনেই এক শিক্ষার্থী শহীদ হন। রাপা প্লাজা থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পুলিশ এবং ছাত্রলীগ সম্মিলিতভাবে আমাদের ওপর রাত পর্যন্ত হামলা চালায়।
এক পর্যায়ে জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারাও আন্দোলনে যোগ দেয়, কারণ জেনেভা ক্যাম্পের এক বাসিন্দার ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাত দেড়টা পর্যন্ত হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো হয় এবং এভাবেই ১৮ জুলাই শেষ হয়।
বাসস : ১৮ জুলাই রাত থেকে সারাদেশে নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তখন কিভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন
মুসাদ্দিক : ১৮ জুলাই রাত ৮-৯টার দিকে সারাদেশে নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। যদি নেটওয়ার্ক আরও আগে বন্ধ হতো, তাহলে হয়তো আমরা বিকল্প প্রস্তুতি নিতে পারতাম বা নির্দিষ্ট স্থানে সংঘবদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দিতে পারতাম। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এসময় সবাইকে এসএমএস পাঠিয়ে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলাম আমি।
১৯ জুলাই আমি সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে বাটা সিগনাল পর্যন্ত কর্মসূচিতে অংশ নিই। এই সময় আমি কয়েকবার পুলিশের হামলার মুখে পড়েছিলাম। তখন আমি সরাসরি দেখেছি কিভাবে পুলিশ কাছ থেকে গুলি চালিয়েছে এবং সেখানে আমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই। ওই সময় নেটওয়ার্ক না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা অবিশ্বাস্যভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়। পাড়া-মহল্লার যুবকরা নিজেরাই সংঘবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। পরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে শাহবাগ পর্যন্ত আসার চেষ্টা করি, কিন্তু বাটা সিগনাল থেকে আবার হেলিকপ্টার থেকে হামলা শুরু হয়। এরপর আমরা বাংলা মোটরের দিকে চলে যাই। ১৯, ২০, ২১ এবং ২২ জুলাই আন্দোলন এক ধরনের অন্ধকারে চলে, কারণ নেটওয়ার্ক ছিল না এবং কারো সাথে যোগাযোগ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
এই সময়ে আমি কয়েকজন মোবাইল জার্নালিস্ট এবং আন্দোলন সমন্বয়কদের সাথে যোগাযোগ করি। তখন আমি আমার অবস্থান থেকে নয় দফার প্রচারের কাজ করতে থাকি। আব্দুল কাদেরের সাথে সমন্বয় করে আমি ২২, ২৩, ২৪ এবং ২৫ তারিখ পর্যন্ত এই কাজ করি। ২৪ তারিখে আব্দুল হান্নান মাসউদ এবং মাহিন সরকারের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে আমি তাদের নিয়ে হাসপাতালগুলোতে আহতদের দেখতে যাই।
বাসস : ২৯ জুলাই আপনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। ২৫-২৯ জুলাই কি কি করেছিলেন?
মুসাদ্দিক : ২৫ তারিখের পরে আমি একটি দূতাবাসে আশ্রয়ের প্রস্তাব পেলেও তা গ্রহণ করিনি। আমার ধারণা ছিল যদি আমি দূতাবাসে আশ্রয় নেই, তাহলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কঠিন হতে পারে এবং এটি দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে আমার সংশয় ছিল।
২৪ তারিখে যখন প্রথম ভালোভাবে নেটওয়ার্ক আসে (বিশেষ করে ওয়াইফাই, মোবাইল নেটওয়ার্ক আসেনি), তখন আমি জাতিসংঘের মানবাধিকার উপদেষ্টা (বাংলাদেশের) হুমা খানের সাথে তার গুলশানের ১১ নম্বর রোডের বাসায় সাক্ষাৎ করি। আমি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া গণহত্যার পরিস্থিতি তুলে ধরি এবং জাতিসংঘকে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য অনুরোধ করি। হুমা খানের আগ্রহেই এই মিটিং অনুষ্ঠিত হয়।
২৯ তারিখে বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২৭ তারিখ ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম ও ২৮ তারিখ দেয়াল লিখন কর্মসূচী পালিত হয়। বিক্ষোভ মিছিল বাস্তবায়নের জন্য সমন্বয়কদের পাওয়া যাচ্ছিল না, কারণ বেশিরভাগই আত্মগোপনে চলে গিয়েছিল বা ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল।
আমি কয়েকটি স্থানে আন্দোলনের জন্য স্পট নির্ধারণ করি এবং কয়েকটি পক্ষের সাথে সমন্বয় করি। এর মধ্যে সায়েন্স ক্লাব (ধানমন্ডি সাইডের সায়েন্স ল্যাব) এবং পল্টন ছিল। ২৮ তারিখ রাতেই ২৯ তারিখ দুপুর ১২টায় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অনেক দিন ধরে মাঠে কোনো মিছিল না থাকায় এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ের আতঙ্ক থাকায় এটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং কর্মসূচি। আমরা সবাই বেলা ১২টার মধ্যে প্রেস ক্লাবের আশেপাশে চলে আসি। তবে, পুলিশের কাছে মিছিলের খবর থাকায় তারা প্রেস ক্লাবের মূল গেটে (১ নম্বর গেট) প্রায় ১৫০-২০০ জন অবস্থান নেয়। ১২টা ২০ মিনিটের দিকে হাইকোর্টের মোড়ে পুলিশের আরেকটি দল রাস্তা বন্ধ কওে দেয়, যাতে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। পল্টন মোড়েও আরেকটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়।
এর আগে শাহবাগে শিক্ষক নেটওয়ার্ক এবং শিক্ষকদের একটি প্রোগ্রাম ছিল, যা ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে আয়োজিত হয়। এই প্রোগ্রাম থেকে শিক্ষকরা বাংলা মোটরের সামনে আসেন এবং আমি সেখানে গিয়ে শিক্ষকদের বলি শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করবে এবং তাদেরকে যোগ দিতে বলি। শিক্ষকদের উপস্থিতিতে পুলিশের হামলা হামলা থেকে কিছুটা হলেও রেহাই পাবো বলে তাদেরকে জানিয়েছিলাম।
১২টা ৪৫মিনিটে পল্টন মোড় থেকে মিছিল শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অনেকে পল্টন মোড়ে আসে, যখন ৪-৫ জন মিলে রাস্তা আটকে স্লোগান দিতে শুরু করি, তখন পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকায় এবং কারফিউ চলার কারণে কেউ সাহস করে রাস্তায় নামতে পারছিল না। প্রায় ৪ মিনিট স্লোগান দেওয়ার পর ২০-২২ জন জড়ো হয়। আমার ইচ্ছা ছিল ৫-৭ মিনিট স্লোগান দিলে ৩০-৪০ জন বা ৪০-৫০ জন জড়ো হলে মিছিল শুরু করা যাবে।
এমন সময় ২০ জনের একটি পুলিশ দল আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। আমার মনে হয়েছিল তারা হয়তো হামলা করবে না বরং আলাপ করতে চায়। এ সময় রমনা এডিসি ইমরুল, যিনি আন্দোলন চলাকালীন নিয়মিত আমার সাথে যোগাযোগ করতেন, তিনি এসে আলাপ করতে চান। আমাকে বলেন, ‘আসেন, আলাপ করি।’
আলাপের কথা বলে ওই পুলিশ অফিসার আমাকে এবং আমার বন্ধুকে ধরে নিয়ে যায়। আমার সাথে থাকা বাকি আরও দুইজন পালানোর চেষ্টা করলেও পুলিশ তাদেরকেও দৌড়ে ধরে ফেলে। পরে পুলিশ সবাইকে প্রেস ক্লাবের ভেতরের দিকে নিয়ে যায় এবং প্রিজন ভ্যান ডাকে। প্রিজন ভ্যান প্রেস ক্লাবের সামনে এলে আমাদেরকে ভ্যানে তোলা হয় এবং পুলিশ আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমি আমার ফোনের সবকিছু ডিলিট করে দিয়েছিলাম। ফলে আমার কাছ থেকে কোনো ধরনের তথ্য পায়নি। আমার সাথে থাকা বাকি তিনজনকে বলে দিয়েছিলাম পুলিশকে কি কি বলতে হবে। তারা আমার কথামতো পুলিশকে জবাব দিয়েছিল এবং পুলিশ তাদের কথা বিশ্বাসও করেছিল।
পরে আমাদেরকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। ডিবিতে আমাদের একদিন রাখা হয় এবং সেখানে মূলত যাদের বয়স কম (১৪-১৫ বছর) তাদের উপর বেশি নির্যাতন চালানো হয়। পুলিশ খুনের ঘটনার জন্য তাদের স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা করছিল। আমাদেরকে বলা হচ্ছিল মারধর করা হবে, নির্যাতন করা হবে এবং মানসিকভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের চাপের কারণে অনেককে রাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই সময় আমার গ্রেফতারের একটি ভিডিও আন্দোলনকারী সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে আমি প্রিজন ভ্যান থেকে স্লোগান দিয়েছিলাম "আন্দোলন চলবে।" আমার এই ঘোষণা ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং চাপ সৃষ্টি করে। এছাড়াও, আমার গ্রেফতারের বিষয়টি আমার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, মানবাধিকার কর্মী ইত্যাদি জায়গায় জানানো হয়। ফলে দেশী ও বিদেশি চাপের কারণে আমাদেরকে ছাড়া হয়।
আমি যে গারদে ছিলাম সেখানে জামাতের নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির নেতা সামিউল হক ফারুকী, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সালাউদ্দিন টুকু, আমানুল্লাহ আমান, আমিনুল ইসলামের মতো হাই-প্রোফাইল নেতারা ছিলেন। ছাত্রদল এবং শিবিরের কিছু নেতাকর্মীকেও সেখানে টর্চার করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছিল।
সেখানে ছাত্রদল এবং শিবিরের ছেলেদের দফায় দফায় মারধর করা হচ্ছিল, বিশেষ করে শিবিরের ছেলেদের বেশি মারধর করা হতো। ছাত্রদলের যারা কয়েকদিন আগে ধরা পড়েছিল, তাদের মারধরের পর্ব আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের রিমান্ড চলছিল। আরিফ, সোহেল, আসিফ মাহাতাবও আমার গারদে ছিলেন। পাশের গারদে নুরুল হক নূর, আন্দালিব রহমান পার্থ এবং অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী ছিলেন, যদিও তাদের সাথে সরাসরি কথা হয়নি।
বাসস : ডিবি হেফাজত থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে কি করেছিলেন?
মুসাদ্দিক : ৩০ জুলাই আমি আমার মোহাম্মদপুরের বাসায় থাকার কারণে আবারও গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কায় ছিলাম। তাই এই পরিস্থিতিতে আমার পরিবারকে বোঝালাম বাড়িতে থাকলে আমার জন্য আরও ঝুঁকি বাড়বে। তখন আমি ৩১ জুলাই ওই বাসা ছেড়ে বাংলা মোটরে এক বড় ভাইয়ের (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের) বাসায় উঠি। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। কারণ তখন আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার মতো তেমন কেউ পপুলার ফেস ছিল না।
ওই দিন রাতে ২ আগস্ট (শুক্রবার) জুমার নামাজের পর মসজিদগুলো থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করার কথা চিন্তা করি। জুমার দিন মানুষ একত্রিত হয় এবং সাধারণ মানুষও তখন সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল, তাই তারা ডাক পেলে রাস্তায় নামতে পারে বলে আমার মনে হয়। তখন আমি শিবিরের তৎকালীন ঢাবি সভাপতি সাদিক কায়েম এবং জামাতের কিছু নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করি। ঢাকার চারটি মসজিদ নির্বাচন করা হয়- সায়েন্স ল্যাব মসজিদ, খিলগাঁওয়ের একটি মসজিদ, যাত্রাবাড়ীর একটি মসজিদ এবং রামপুরার একটি মসজিদ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই মসজিদগুলো থেকে জুমার নামাজের পর ‘জনতার শোক ও গণমিছিল’ বের হবে।
শুক্রবার সায়েন্সল্যাবের মসজিদ থেকে একটি বিশাল মিছিল বের হয়, যেখানে আমি নিজেও অংশগ্রহণ করি। এটি ছিল ঢাকার মধ্যে অন্যতম বড় মিছিল। অন্যান্য মসজিদ থেকেও বড় বড় মিছিল বের হচ্ছিল এবং সেদিন সারাদেশে মসজিদগুলো থেকে মিছিল বের হয়েছিল। এই মিছিলের মাধ্যমেই আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
বাসস : এক দফার ঘোষণা কীভাবে আসলো?
মুসাদ্দিক : ১ ও ২ আগস্ট এই দুইদিন খুলনা এবং কুমিল্লায় পুলিশ গুলি চালায় এবং কয়েকজন শহীদ হন। এতদিন আন্দোলন নয় দফা দাবিতে চলছিল, কিন্তু এই ঘটনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে আর নয় দফায় থাকার সুযোগ নেই, আন্দোলনকে এক দফায় নিয়ে যেতে হবে। এক দফা ঘোষণার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছিল- কেউ অনলাইনে ঘোষণা দেওয়ার কথা বলছিল, কেউ কেউ শহীদ মিনার থেকে।
আমাদের আশঙ্কা ছিল যে শেখ হাসিনা নয় দফা দাবি মেনে নিতে পারেন, দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন এবং কিছু মন্ত্রীকে সরাতে পারেন। কারণ, তিনি তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে ক্ষমতায় থাকার আর কোনো বিকল্প নেই, যদি এই দাবিগুলো মেনে নিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু যদি এক দফা ঘোষণা না করা হয়, তাহলে আমাদের দাবিগুলো পূরণের আগেই আন্দোলন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কার মধ্যে কেউ কেউ ২ আগস্ট রাতেই এক দফা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছিল। তবে, শেষ পর্যন্ত ৩ আগস্ট সমাবেশ থেকে সরাসরি এক দফা ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়।
৩ আগস্ট দুপুর ৩টায় শহীদ মিনারে সমাবেশ হয়। রিকশাচালকরা সেদিন খুব সহযোগিতা করে, তারা কোনো ভাড়া নেয়নি এবং সবাইকে বিনামূল্যে সমাবেশে নিয়ে আসে। এতে অনেক লোক জড়ো হয়। একটি হ্যান্ড মাইক ছিল, সেসময় বড় মাইক পাওয়া যাচ্ছিল না কারণ মাইক কোম্পানিগুলো মাইক ভাড়া দিতে রাজি ছিল না। এক পর্যায়ে মিফতাহুল মারুফ, যিনি জিয়া হলে আমার রুমমেট ছিলেন, তিনি একটি বড় মাইকের ব্যবস্থা করেন।
যদিও মাইকের সাউন্ড ভালো ছিল না, তবুও সেদিন ওই মাইকেই সমাবেশ হয়। এক দফা ঘোষণা হবে কিনা, এ নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা ছিল, কারণ যাদের এক দফা ঘোষণা করার কথা ছিল, তাদের মধ্যে দোদুল্যমানতা দেখা যাচ্ছিল। তবে, শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে বিকেল ৪টা বা ৪:৩০টার দিকে এক দফা ঘোষণা করা হয়।
বাসস : ৩৫ ও ৩৬ জুলাইয়ের ঘটনাগুলো কেমন ছিল?
মুসাদ্দিক : ৪ আগস্ট সকাল ১০টায় শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি ডাকা হয়। এর কারণ ছিল, ‘শাহবাগ যার দখলে, আন্দোলন তার দখলে। ছাত্রলীগ ১২টা থেকে শাহবাগ দখল করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা পরিকল্পনা করে সকাল ১০টায় অবস্থান কর্মসূচি ডাকি। যাতে শিক্ষার্থীরা সকাল ৮-৯টা থেকেই শাহবাগে আসতে শুরু করে।
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতিসহ কিছু নেতা পিজি হাসপাতালের ভেতরে রোগীদের আবাসিক হোটেল এবং কেবিনগুলোতে অবস্থান নিয়েছিল। তারা ভেতর থেকে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা শুরু করে। শাহাবাগ থানার ২২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসাদের কার্যালয়ে তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রস্তুত ছিল এবং সেখান থেকে হামলা চালিয়ে শাহবাগ থেকে আমাদেরকে বিতাড়িত করার চেষ্টা করে।
এতোদিনে ছাত্রলীগের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল। সারাদেশে এত চেষ্টা করেও তারা সংঘবদ্ধ হতে পারছিল না। যারা ছাত্রলীগের সাথে গিয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই ছাত্রলীগ থেকে সরে এসেছিল। ছাত্রলীগ নেতৃত্বশূন্য এবং জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। তাদের পাল্টা হামলা করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ সবাই ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল।
তারা বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে হামলার চেষ্টা চালায়। আমরা ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে হামলা প্রতিহত করি। এক পর্যায়ে শাহবাগ থেকে তাদের হটাতে সক্ষম হই। ছাত্রলীগ গুলিও চালাচ্ছিল, কিন্তু প্রতিরোধের মুখে তারা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গাড়ি ও মাইক্রোবাস পুড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। আমরা কাউন্সিলর আসাদের কার্যালয় থেকে অনেক লাঠিসোঁটা উদ্ধার করি। শাহবাগ নিয়ন্ত্রণে আসার সময় কোনো সমন্বয়ক ছিল না। আমি ও আমার বন্ধু এবি জুবায়ের, খালিদসহ কয়েকজন বন্ধু এবং আন্দোলনকারীরা মিলে শাহবাগ নিয়ন্ত্রণ করি। আমাদের হাতে মাইক ছিল এবং আমরা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলাম। এরপর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (চরমোনাই) কয়েক হাজার লোকের একটি বিশাল মিছিল প্রেস ক্লাবের পাশ দিয়ে শাহবাগের দিকে আসে। যা আমাদের অবস্থানকে শক্ত করে তোলে।
৪ তারিখে ২ দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হলেও পরে অলনাইলের মাধ্যমে একদিন এগিয়ে নিয়ে ৫ তারিখে মার্চ টু ঢাকা ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণা মূলত নাহিদ ইসলাম একটি রিকশার উপর দাঁড়িয়ে দেন, যেখানে আমি পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
৫ আগস্ট সকালে আমরা রাস্তায় নামতে পারেনি, কারণ পুরো রাস্তা সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। চানখাঁরপুল সাইড দিয়ে শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে ঢোকার চেষ্টা করলে সেখানে পুলিশ ব্রাশফায়ার করে এবং ৪-৫ জন শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতা শহীদ হয়।
তখন আমি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালের পাশে ছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল শাহবাগে জড়ো হওয়া এবং বাকিরা শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে সেখান থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগে প্রবেশ করবে। সকাল ১০ থেকে ১১টা পর্যন্ত আমরা শাহবাগে প্রবেশ করতে পারিনি। হাসপাতালের পিছনে যেখানে সবাই ছিল সেখানে আমি অবস্থান নেই। পরে ১২টার দিকে আমরা বিশাল দল নিয়ে শাহবাগে প্রবেশ করি। এর আগে শাহবাগের ব্যারিকেড কয়েক দফায় ভাঙ্গা হয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণে পুরোপুরি সুবিধা করা যায়নি। দেড়টার দিকে শাহবাগ সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
এ সময় আমরা সংবাদ পাই যে শেখ হাসিনা দুপুর ১টার আগেই ভারতের উদ্দেশ্যে পালিয়ে গেছেন।
তখন আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। একটি পাখি যেমন আকাশে উড়ে তেমনি আমিও স্বাধীনতার আকাশে উড়তে থাকলাম....। ভাবতে থাকলাম আজ থেকে আর কোথাও অত্যাচার-নির্যাতনের স্বীকার হতে হবে না। আজ থেকে আমি স্বাধীন, আমার বাংলাদেশ আরও একবার স্বাধীন হলো।