ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদের সঙ্গে কারও বনিবনা না হলে স্পেশাল টিম পাঠিয়ে তাকে ধরে এনে টর্চার সেলে বন্দি করে রাখা হতো। এমন অসংখ্য ভুক্তভোগী পাওয়া গেছে। তারা জানান, হারুন বিএনপি-জামায়াত-সমর্থিত অসংখ্য নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে আটকে রেখে অমানবিক নিযার্তন করত। অনেকে আবার দীর্ঘদিন ধরে গুম ছিল ডিবি কাযার্লয়ে।
ডিবি কার্যালয়ের টর্চার সেলে কাউকে ১০, ১৫, ২০ দিন বা মাসের পর মাস আটকে রাখা হতো। তাদের মধ্যে ভুক্তভোগী ঢাকা কলেজের ছাত্রনেতা রাশেদ জানান, হারুন আমাকে একবার ধরে নিয়ে ১৪ দিন আটকে রাখে। ওই সময় আমার পরিবার আমাকে খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
রাজধানীর সবুজবাগ থেকে পুলিশের গাড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপি নেতা আব্বাস বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। শত্রুতার জেরে হারুন আমাকে জেলা থেকে ধরে নিয়ে এসে গাড়ি পোড়ানো মামলা দেয়। শুধু মামলা নয়, আমাকে ১৫ দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় আটকে রেখে অমানবিক নিযার্তন করে। তিনি বলেন, সরকার পদত্যাগের পর ডিবি অফিসে কয়েকবার গিয়েছি, সেখানে গিয়ে দেখি ভুক্তভোগী অনেকেই হারুনকে খুঁজছে, তাদের সঙ্গে আমিও তাকে খুঁজছি। তাকে পেলে জানতে চাই কী অপরাধ ছিল আমার।
ডিবি পুলিশের একটি সূত্র জানায়, মূলত হারুন আওয়ামী লীগের কিছু এমপি-মন্ত্রীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করত। এসব এমপি-মন্ত্রীর কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা ও বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিত। তবে গত ৫ আগস্ট তিব্র গণআন্দোনের মুখে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর হারুনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ আসতে থাকে।
জানা যায়, বিভিন্ন মানুষকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, জিম্মি, গুম ও খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল পুলিশ কর্মকর্তা হারুন। হারুন পুলিশের পোশাকের আড়ালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। হারুনের এসব অপকর্মের বিষয়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সবই জানতেন। হারুনের সঙ্গে সরাসরি শেখ হাসিনার যোগাযোগ থাকায় অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ও এমপি-মন্ত্রীরা তাকে ভয় পেত। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে হারুন। 
সূত্র জানায়, মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে হারুনের নিজস্ব একটা টর্চার সেল রয়েছে। এ ছাড়া ধানমন্ডি, উত্তরা ও মিরপুরে রয়েছে তিনটি টর্চার সেল। হারুনের এসব অপকর্মের সহযোগী লালবাগ জোনের ডিসি (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) মশিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা।
হারুনের কাছে কারোর ক্ষমা নেই
হারুন ডিবিতে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ঢাকা আইনজীবী সমিতির আজীবন সদস্য সৈয়দ আজহারুল কবির ও স্ত্রী মেহেরুন্নেসার ৩০০ কোটি টাকার জমি দখল করে নিতে চেয়েছিল। হারুনের উদ্দেশ্য ছিল পুরো জমি দখল করে নেওয়ার। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বৈধ জমি অবৈধ করার চেষ্টাও করেন হারুনের ডিবি চক্র।
এ বিষয়ে আইনজীবী সৈয়দ আজহারুল কবির ও স্ত্রী মেহেরুন্নেসা জানান, হারুন নিজেই আমাদের ধরে নিয়ে ডিবি অফিসে কথা বলেছেন। সে আমাদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। আমাদের বলে আপনি জমি চান, না সুন্দর ভবিষ্যৎ। এরপর আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম। তারপরও হারুনের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাদের ছেলে ব্যারিস্টার সৈয়দ এজাজ কবিরকে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে গ্রেপ্তার করে ১০ দিন টর্চার সেলে রাখে এবং শারীরিক নির্যাতন করে।
বিশ্বস্ত সূত্রে আরও জানা যায়, হারুন সাবেক আইজিপি শহিদুল হকের ছোট ভাইয়ের সহযোগিতায় সারাদেশে হুন্ডি ও স্বর্ণ চোরাচালানে সরাসরি যুক্ত ছিল। কয়েকবার বিভিন্ন মহলে হারুনের এসব অপকর্ম নিয়ে আলোচনাও হয়। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কেউ কখনো সাহস করে অভিযোগ করতে পারেনি। সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে হারুন।
হারুন বিএনপি নেতা বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে রাজনৈতিক মামলায় কয়েকবার গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে একবার তার ভাতের হোটেলে জোরপূর্বক ভাতও খাওয়ান। গয়েশ্বরকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডের আবেদন করে ডিবি পুলিশ। রিমান্ডের নামে গয়েশ্বরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেয় পুলিশের এই কর্মকর্তা। এ ছাড়া, বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গ্রেপ্তার করে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মাসোহারা নিয়েছে পুলিশের এই অসৎ কর্মকর্তা। হারুনের বিরুদ্ধে যদি কেউ কখনো কথা বলে সেটা পুলিশ হোক বা সাধারণ মানুষ তাদের ধরে নিয়ে টর্চার সেলে কয়েক দিন আটকে রাখত। যাতে তাদের খোঁজ না পেয়ে পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়ে।
এদিকে, এমপি আনার হত্যায় জড়িত কিলারদের সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল হারুনের। তিনি আনার হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিভিন্ন মহলে আলোচনার শীর্ষে আছেন। হারুন স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এমপি আনার হত্যার ঘটনায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা অধিকাংশই অপরাধী নয় বলে জানিয়েছেন তাদের পরিবার। তবে হারুন মিডিয়াকে ব্যবহার করে নিজেই বিভিন্ন সময় আনার হত্যায় বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়েছেন।
বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে গত বছরের ২৮ অক্টোবর অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। ১০ থেকে ১৫ দিন বেশ কিছু নেতাকর্মী নিখোঁজ ছিল। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী হারুনের টর্চার সেলে বন্দি ছিলেন।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে ২৮ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয় তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের নেতা বায়জিদ, আবু বক্কর সিদ্দিকী ও সেলিম রেজা। তাদের ১৫ দিন উত্তরা টর্চার সেলে রেখে নির্যাতন করে ডিবি পুলিশ। মাঝে মাঝে সেখানে গিয়ে হারুন ক্রসফায়ারের হুমকি-ধামকি দিতেন। এরপর মোটা টাকা ও মিথ্যা জবানবন্দি নিয়ে আদালতে প্রেরণ করেন।
অভিযুক্ত ছাত্র নেতারা জানান, হারুন ও ডিবি পুলিশের মশিউর রহমান তাদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন করছে। প্রাণে মেরে ফেরার ভয় দেখিয়ে পরিবারের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে হারুন চক্র।
ডিবি পুলিশের হারুন এভাবেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। হারুনের কৃতকর্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পুলিশের বেশ কিছু কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আমরা একটি দক্ষ, নিরপেক্ষ ও জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে পুলিশ সংস্কারে উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছি। আর পুলিশের দায়িত্ব পালনের সময় যারা অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করছে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে সভাপতি করে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ৪৫ দিনের মধ্যে এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করলে সকল অপরাধীদের তথ্য উঠে আসবে।
বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেছেন, ছাত্র আন্দোলন থেকে উদ্ভূত নজিরবিহীন গণবিক্ষোভ, সহিংসতা, প্রাণহানির মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব নিয়েছি। পুলিশের পোশাকের আড়ালে যারা নৈরাজ্য করেছে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তাছাড়া, কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশ যেভাবে নির্বিচার গুলিসহ মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে, তার মধ্যে নিবর্তনমূলক পুলিশ বাহিনীর চরম প্রতিফলন ঘটেছে। সবকিছু তদন্ত করা হচ্ছে, এসব বিষয়ে পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার কারণে চরম আক্রোশের শিকার হয়েছে বাহিনীটি। তাছাড়া সহিংসতার মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক পুলিশ সদস্য। কয়েকশ থানাসহ পুলিশের বহু স্থাপনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সবকিছু নতুন করে সাজানো হচ্ছে এবং পুলিশ সংস্কারের কাজ চলছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা রুপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘ডিবির সাবেক কর্মকর্তা হারুনের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ও অন্তর্র্বতীকালীন সরকার। হারুনের সার্বিক বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তথ্য-প্রমাণ হাতে এলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 
                            -20240902091426.jpg) 
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                    -20251031160223.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন