প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে নাশকতার আগুনের পুড়ে ছাই হয়েছে সাত নম্বর ভবনে থাকা তিন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। বুধবার রাত ১টা ৫২ মিনিটে লাগা এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। একই রাতে মিন্টো রোডের সচিব নিবাসেও আগুনের ঘটনা ঘটে। গভীর রাতে সচিবালয়ে লাগা এ আগুনকে নাশকতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান কর্মকে স্থবির করে দেওয়ার হীনচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সরেজমিন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও সচিবালয়ের এ আগুনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
স্বাধীনতার পর প্রথম সচিবালয়ে লাগা এ আগুনের কারণ ও উৎস খুঁজে বের করতে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও প্রাথমিকভাবে জানাতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের ওই কর্মকর্তারা। বাহিনীর মহাপরিচালকও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে নাশকতা হিসেবে ইঙ্গিত করেছেন।
সচিবালয়ের এই সাত নম্বর ভবনে অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে। তবে এর মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নকল ফাইল ও নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়েছে।
সচিবালয়ের আগুনের পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করেছে কি না, তদন্তের পর তা বলা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডকে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। এ ‘ষড়যন্ত্রে’ যে বা যারাই জড়িত থাকুক, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। আর পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সিনিয়র চিফ পেটি অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম বলেছেন, আগুন শর্ট সার্কিট থেকে লাগেনি, পরিকল্পিতভাবে কেউ হয়তো আগুন লাগিয়ে থাকতে পারে।
উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন, ৩ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন : সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস খুঁজে বের করতে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঘটনার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একটি জরুরি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে বলা হয়।
তিনি আরো বলেন, এই কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। সদস্য হিসেবে থাকবেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব, পুলিশের আইজিপি, ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (সদস্যসচিব), সশস্ত্র বাহিনীর একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েট থেকে ৩ জন বিশেষজ্ঞ, একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার।
বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা আরও জানান, এই কমিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও উৎস এগুলো খুঁজে বের করে আগামী তিন দিনের মধ্যে একটি প্রাথমিক রিপোর্ট সরকারকে দেবে।
তিনি আরও জানান, প্রাথমিক প্রতিবেদনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে বিস্তারিত জানানো না গেলেও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন গণমাধ্যমকে পুরোটাই জানানো হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
পরিকল্পিত আগুন নৌবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম: সচিবালয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটা ভবনের নানা জায়গায় কীভাবে আগুন লাগল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো দেখিনি কীভাবে আগুন লেগেছে। তবে আমরা ভেতরের পরিস্থিতি দেখে ধারণা করছি, কোনো শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগেনি। যদি শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগত তাহলে নানা স্থানে আগুন লাগত না। কে, কারা বা কীভাবে আগুন লাগল তার সঠিক তথ্য এখনো আমাদের হাতে আসেনি। প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয় কেউ পরিকল্পিতভাবে এই কাজটি করেছে।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানান, সচিবালয়ে আগুন লাগার খবর পেয়ে তারা রাত ১টা ৫২ মিনিটে পান তারা। দুই মিনিটের মধ্যে তাদের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করেন। প্রথমে আটটি ইউনিট কাজ শুরু করলেও পরে আরো দশটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যোগ দেয়। আগুন লাগার পর কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় পুরো সচিবালয় এলাকা।
সেনাবাহিনী, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরাও পরে আগুন নেভানোর কাজে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সঙ্গে যোগ দেন। এদিকে সচিবালয়ে আগুন লাগার পর সেখানে ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম।
আগুনের ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনের কলাপসিবল গেট কেটে ভেতরে ঢুকে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। ভবনের সিঁড়িতে হোস পাইপ থেকে ছোড়া পানির স্রোত বইছে। এদিকে সচিবালের কাছে আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত একজন ফায়ার ফাইটার রাস্তা পার হতে যাওয়ার সময় ট্রাক চাপায় গুরুতর আহত হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে আনোয়ারুল ইসলাম জানান।
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে একটি কুকুর ও কিছু কবুতরের পুড়ে যাওয়া মরদেহ পাওয়ার খবর দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে আমরা বেশ কিছু মৃত কবুতরও পেয়েছি; যেগুলো ওখানে থাকত।
ফায়ার সার্ভিসের আরেক কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, সাত নম্বর ভবনের সপ্তম কিংবা অষ্টম তলা থেকে আগুনে পুড়ে যাওয়া একটি কুকুরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পুড়ে গেছে ও ফুলে ছিল মৃত কুকুরটি।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ৬, ৭, ৮, ৯ এই চারটি তলা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম তলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি, সেখানকার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে।
নাশকতা কি না, তদন্তের পর বলা যাবে-স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা: প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের আগুনের পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করেছে কি না তা তদন্তের পর বলা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল সচিবালয়ের সামনে তিনি বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই আগুনের পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা নাশকতা দেখছেন কি নাÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা ইনভেস্টিগেশনের আগে বলতে পারব না। ইনভেস্টিগেশনের পরে আপনাদের আমরা জানাব।
এর আগে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল ব্রিফিংয়ে বলেন, সচিবালয়ের আগুন লাগার কারণ সম্ভবত ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন ছিল। এক জায়গায় আগুন ধরলে বিদ্যুৎ লাইনের মাধ্যমে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এটা হতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক কারণ এখনো আমরা বের করতে পারিনি। আগুন নেভানোর পর আমরা যখন সব জায়গা তল্লাশি করব, তখন আপনাদের বলতে পারব। আগুনের উৎসের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস কিছু জানিয়েছে কি না এ প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এটা তদন্তের পরে বলা যাবে। উপদেষ্টা বলেন, এ ঘটনায় আমাদের একজন ফায়ার ফাইটার নিহত হয়েছেন। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। একটা পাইপ নিয়ে সচিবালয়ের দিকে আসছিলেন, রাস্তা পার হচ্ছিলেন, এ সময় একটা ট্রাক তাকে ধাক্কা দেয়।
সরেজমিনে যা দেখা গেছে: আগুনের ঘটনায় সকাল সাড়ে ৬টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আগুন লাগা ভবনটির বিভিন্ন জানালা দিয়ে তখনো গলগল করে ধোঁয়া বের হচ্ছে। দমকল বাহিনীর কর্মীরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন, পানির বড় পাইপ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিয়ে ছোটাছুটি করছেন তারা। সে সময় দুটি বড় ল্যাডার দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছিল। সকাল থেকেই আস্তে আস্তে কর্মস্থলে যোগ দিতে সচিবালয়ের কর্মীরা আসতে থাকেন। সচিবালয়ের চারপাশে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের ভিড় দেখা গেছে, আগুন লাগার খবর পেয়ে আশপাশ থেকে অনেকে এসেছেন। যদিও নিরাপত্তা কর্মীরা বাইরের কাউকে সচিবালয় প্রাঙ্গণে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না। সচিবালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ রাখা হয়। প্রথমদিকে এমনকি সচিবালয়ের কর্মীদেরও ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
আগুন নেভাতে এত সময় লাগল কেন? রাত পৌনে ২টায় লাগা আগুন নেভাতে ছয় ঘণ্টার বেশি সময় লাগা এবং আগুন নেভাতে এত ইউনিটের এত সময় কেন লেগেছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, জায়গাটা কনফাইনড (আবদ্ধ)। সব কক্ষ ভেতর থেকে আটকানো থাকায় গ্লাস বা দরজা ভেঙে পানি দিতে হয়েছে। এতে সময় লেগেছে। ভবনজুড়ে বিদ্যুতের তারের সংযোগের কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় নেভাতে বেগ পেতে হয়।

 
                             
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                    -20251031160223.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন