আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে কিস্তি পেতে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কিছুটা হোঁচট খেলেও ঋণ প্রাপ্তির বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। যদিও মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার মতো অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে আরও সময় নেবে বাংলাদেশ। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব নীতি থেকে রাজস্ব প্রশাসনকে আলাদা করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া রাজস্ব আদায় বাড়ানো, ভর্তুকি কমানো ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখছে সরকার।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শর্ত পূরণে বাংলাদেশ ও আইএমএফ নিজ নিজ অবস্থানে নমনীয় রয়েছে। ফলে এই দফায় ঋণের দুটি কিস্তি একসঙ্গেই আগামী জুন মাসে পাওয়া যাবে। তবে বাংলাদেশ যদি কোনো কারণে আইএমএফের কিস্তি না পেত, তাহলে অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোও তখন বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে রক্ষণশীল হতে পারে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ নিজেও তা স্বীকার করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি থেকে দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পেতে বাংলাদেশের সামনে তিনটি মূল চ্যলেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করাটা বাংলাদেশের জন্য জটিল। এগুলো হলো-মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তি রাজস্ব আদায় ও এনবিআরের রাজস্ব নীতি থেকে রাজস্ব প্রশাসনকে আলাদা করা।
আগামী জুনের মধ্যে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার বাস্তবায়নের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি প্রাক-বাজেট আলোচনায় বলেন, তা এখন বলব না। কারণ, মূল্যস্ফীতি আরও কত দিন থাকে, দেখতে হবে। হঠাৎ বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ায় পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে গেলে তো বিপদ বাড়বে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হচ্ছে। যার কারণে হঠাৎ ডলারের দাম খুব বেশি বেড়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ পদ্ধতিতে ডলারের দাম আপাতত ১২২ টাকায় স্থিতিশীল।
এদিকে ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্ত পালনের অগ্রগতি পর্যালোচনায় আইএমএফের একটি দল আগামী ৫ এপ্রিল ঢাকায় আসছে। দলটি ৬ এপ্রিল থেকে টানা দুই সপ্তাহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এ সফরে আইএমএফের দলটির সঙ্গে অর্থ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠক শেষে ১৭ এপ্রিল প্রেস ব্রিফিং করবে সফররত আইএমএফের দল। দলটি প্রথম দিন ৬ এপ্রিল এবং শেষ দিন ১৭ এপ্রিল বৈঠক করবে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।
২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ঋণ কর্মসূচি চালু হওয়ার পর আইএমএফ থেকে তিন কিস্তিতে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। বিপত্তি দেখা দেয় চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে। সরকার আশা করছে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে পাওয়া যাবে আগামী জুন মাসে। বিষয়টি অর্থ বিভাগের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, ৬ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ে আগামী ৬ থেকে ১৭ এপ্রিলে আইএমএফের যে পর্যালোচনা মিশন ঢাকায় আসবে তার প্রস্তুতির জন্য একটি পর্যালোচনা সভা হয়েছে। এই সভায় অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভা সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের দেওয়া বিভিন্ন সংস্কারের অগ্রগতি ভালো হয়েছে। এরমধ্যে এনবিআর তাদের আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সংস্কারেরও তারা ভালো করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে ভালো করলেও কিছু ক্ষেত্রে এখনো বাকি রয়েছে। এ জন্য তাদের আরও সময় লাগবে বলে জানানো হয়েছে।
সম্প্রতি অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের সঙ্গে এক প্রাক্-বাজেট আলোচনায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বাজেট সহায়তার জন্যই আইএমএফ ঋণ লাগবে। এ কারণেই বাংলাদেশ সরকার ও আইএমএফ যৌথভাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত দুটি কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের বিষয়ে সম্মত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভর্তুকি কমানোর অংশ হিসেবে আইএমএফ বিদ্যুতের দাম আরও বাড়াতে বলতে পারে এবং এটিকে সংস্থাটির বাড়াবাড়ি বলেও মনে করেন তারা। তাদের যুক্তি, মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে ভরসা পাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়ে যেতে পারে। তাই সরকার ভেবেচিন্তেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আর আইএমএফেরও উচিত বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝা।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। অন্তত ৫৭ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আদায় করতে হবে। তারপরও রাজস্ব আদায় বাড়াতে উদ্যোগ কম। তবে আইএমএফের শর্ত মানতে এনবিআরের নীতি ও প্রশাসন বিভাগ আলাদা হতে যাচ্ছে। আয় বাড়াতে এনবিআর কর অব্যাহতি কমানো হবে বলে বলা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে বলে বলা হচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে কর অব্যাহতির বিরুদ্ধে একাট্টা অবস্থান বোঝা যাচ্ছে।
প্রতিবার কিস্তি পাওয়ার আগে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদের অনুমোদন লাগে। এর আগে ঋণের শর্ত পূরণের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য ঢাকায় আসে আইএমএফের দল। চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের লক্ষ্যে আইএমএফের শর্তাবলি পর্যালোচনা করতে আইএমএফ মিশনের প্রধান ক্রিস পাপাদাকিসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গত ৩ থেকে ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফর করে। এই সফরের পরই কিস্তি ছাড় পিছিয়ে যায়।
এই সফরে আইএমএফ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। আইএমএফের শর্তগুলোর মধ্যে আছে নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ, বাজেট ঘাটতি, আন্তর্জাতিক লেনদেনের ভারসাম্য, রিজার্ভ মানি, কর রাজস্ব, অগ্রাধিকার সামাজিক ব্যয় এবং সরকারের মূলধন বিনিয়োগ।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলোও বলছে, আইএমএফ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি পেতে ১২টি শর্তের সবই পূরণের পথে থাকলেও বিবি সংস্কারে পিছিয়ে রয়েছে। 
 

 
                             
                                    
-20250402140525.webp)

 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                    -20251031160223.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন