রোহানের বয়স ১১ বছর। সারা দিন রাস্তায় প্লাস্টিকের বোতল ও কাগজ কুড়িয়ে বস্তায় ভরে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করে। সেই টাকায় খাবার কিনে খায়, সঙ্গে ড্যান্ডিও। ড্যান্ডির পেছনে রোজগারের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় হয়। খাবার তিনবেলা না হলেও ড্যান্ডি তার লাগবেই। অনেক সময় পথচারীরা ৫-১০ টাকা বা খাবার কিনে দেয়। ৮ বছর বয়সে রোহানের মা মারা যায়, এরপর বাবা অন্য জায়গায় বিয়ে করলে ময়মনসিংহের রোহান ট্রেনে চড়ে ঢাকার কমলাপুরে চলে আসে। সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে শ্যামলীতে।
রাত হলে শ্যামলী স্কয়ারের ফুটওভার ব্রিজে ছেঁড়া জামা-কাপড় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। গত তিন বছরে রোহানের বাবা তাকে খোঁজার চেষ্টাও করেনি, তাতে আর বাড়ি ফেরাও হয়নি। রোহান ছাড়াও শ্যামলী ফুটওভার ব্রিজ ও আশপাশের এলাকায় ১০-১২ জন পথশিশু নিয়মিত বসবাস করে। এরা সবাই মাদকাসক্ত, কেউ ড্যান্ডি আবার কেউ গাঁজায় আসক্ত। এর মধ্যে দুজন মাদক বহনের কাজেও যুক্ত বলে জানা গেছে। মাদক বহন করলে ফ্রি মাদক পাওয়ার পাশাপাশি টাকাও পায় মাদক কারবারিদের কাছ থেকে।
মাদক এক অভিশাপের নাম, এক সর্বনাশের নাম। এটি এমন একটি সামাজিক সমস্যা, যা শুধু অপরাধের জন্ম ও বিকাশ সাধন করে না, বরং এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর এটা এমনই এক বিষ, যা ধীরে ধীরে বিবর্ণ করে দিচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্মকে। নষ্ট করে দিচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ। ভয়াবহ মাদক ড্যান্ডির মারাত্মক ছোবলে আগামীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
শুধু প্রাপ্তবয়স্ক নয়, এখন মাদক নিতে দেখা যায় পথশিশুদেরও। তাদের নেতিবাচক পারিপার্শ্বিকতা মাদককে করেছে এই অবহেলিত শিশুদের জন্য সহজলভ্য। এখনই সচেতন না হলে এর ভয়াবহতায় সমাজ হবে কলুষিত। সরকারের উদাসীনতায় কয়েক লাখ পথশিশু রাস্তায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। কমলাপুর ও সদরঘাটের অধিকাংশ শিশুই গাঁজা খেয়ে নেশা করে। তবে সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের সবচেয়ে ‘প্রিয়’ ড্যান্ডি। গাঁজা, চাক্কি (ঘুমানোর ওষুধ) ও ড্যান্ডি (জুতার আঠা) সেবন করে।
সারা দেশে প্রায় ১৪ লাখ পথশিশু কোনো না কোনো মাদকে আসক্ত। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ সব ধরনের বাসস্ট্যান্ড, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিভিন্ন পার্কসহ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের হরহামেশাই দেখা যায়। তবে ঢাকার বাইরেও এরা সংখ্যায় কম নয়। বর্তমানে পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই এখন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মাদকে আসক্ত।
ঢাকা শহরে কমপক্ষে ৩৫০টি স্পট রয়েছে। এসব জায়গায় ৯-১৮ বছর বয়সি শিশুরা মাদক সেবন করে। দেশে মাদক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মানুষ নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। পথশিশুদের কাছে মাদক বিক্রির জন্য একটা সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করে। ভাঙারি ক্রেতারাই শিশুদের কাছ থেকে ভাঙারি কিনে নেয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের হাতে মাদক তুলে দেয়। পথশিশুদের মধ্যে শৈশবে নানা পারিবারিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি প্রভৃতির শিকার হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া শিশুদের সংখ্যাই বেশি। তাদের বেশির ভাগই বিপথে থাকা বড়দের কবলে পড়ে মাদকাসক্ত হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশের সর্বশেষ আদমশুমারিতে ভাসমান মানুষ সম্পর্কে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, দেশে ৪ লাখের মতো পথশিশু রয়েছে, যার অর্ধেকই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকায়। মাদকের চোরাচালান, বাজারজাত ও সামগ্রিক বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে কোমলমতি শিশু-কিশোররাও। পথশিশুদের কাছে মাদক হিসেবে আকর্ষণীয় প্রাণঘাতী নেশা ড্যান্ডি দেশের যুবসমাজ থেকে শুরু করে নারী-শিশুরাও আজ মাদকের জন্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আজকের শিশু আগামী দিনের কর্ণধার। অথচ আগামী দিনের কর্ণধারদের এভাবে সমূলে ধ্বংস করে দিচ্ছে ভয়াবহ মাদক।
রাজধানীর সড়কের ফুটপাতগুলোতে পথশিশুদের বসবাসে দিনে বা রাতে নারী ও শিশুরা ভয়ে চলাচল করতে পারে না। রোকেয়া বেগম নামের এক পথচারী রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বাচ্চাদের নিয়ে ফুটপাতে চলাচল করতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কেননা, ফুটপাতে বসেই পথশিশুরা মাদক সেবন করে। অন্যদিকে, অনেক পথশিশু পথচারীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা নেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। দিনের বেলায় ফুটপাতে বসে মাদক সেবন করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কোনো ব্যবস্থা নেয় না। মাদক সেবনরত পথশিশুদের আটক করে ঝামেলায় জড়াতে চায় না তারা।
কেননা, আটককৃতদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠানো হয়ে থাকে। এখানেই যত গন্ডগোল, পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রয়োজনের তুলনায় সিটের সংখ্যা নামমাত্র। মহিলা ও শিশু, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্রের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়িত্ব পথশিশুদের পুনর্বাসন করা। কিন্তু কয়েক লাখ পথশিশুর ক্ষেত্রে হাজারের কমসংখ্যক সিট রয়েছে পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে। সরকারের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, পুনর্বাসন কেন্দ্রে নামমাত্র সিট দিয়ে লাখ লাখ পথশিশুকে পুনর্বাসন করা অসম্ভব। সরকারের উচিত দ্রæত পথশিশুদের পুনর্বাসনে বৃহৎ ব্যবস্থা নেওয়া। না হলে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত এসব লাখ লাখ পথশিশু দেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠবে। সঙ্গে এরাই নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘিœত করবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. ফিরোজ উদ্দিন খলিফা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, সরকারের একাধিক সংস্থার জরিপ অনুযায়ী পথশিশুদের বিরাট একটি অংশ মাদকাসক্ত। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নিয়মিত পথশিশুদের পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তবে এটা ঠিক, ঢাকা বা সারা দেশে যতসংখ্যক পথশিশু রয়েছে, সেই তুলনায় পুনর্বাসনকৃত শিশুর সংখ্যা সীমিত। মন্ত্রণালয় মাদকাসক্তসহ সব ধরনের পথশিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে।
ঢাকার কমলাপুর ও কারওয়ান বাজারে ভাড়া বাসায় দুটি পুনর্বাসনকেন্দ্র রয়েছে। এখানে ১৫০টি সিটের বিপরীতে প্রতি মাসে সব কটি সিট পরিপূর্ণ থাকে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের শিশুদের তিন বেলা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেওয়া হয়। ধর্মীয় শিক্ষক রেখে তাদের নিয়মিত শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো, যাতে করে বেশিসংখ্যক পথশিশুকে পুনর্বাসন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে সরকারের কাজে কার্যক্রম বাড়াতে নতুন পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর কমলাপুর, মতিঝিল, রাজারবাগ, সদরঘাট, গুলিস্তান, খিলগাঁও, গাবতলী, মালিবাগ, তেজগাঁও, রামপুরা, শ্যামলী, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা এলাকাসহ অলিগলিতে এবং বস্তির অনেক জায়গাতেই পথশিশুদের নেশা করতে দেখা যায়। পথশিশুদের কেউ কেউ দিনের বেলা নেশা করলেও বেশির ভাগই নেশা করে রাতে। কেউ একা, আবার কেউ কেউ গোল হয়ে বসে সংঘবদ্ধ হয়ে নেশা করে। পলিথিন, প্লাস্টিক ছাড়াও নিজের পরিধেয় জামায় ড্যান্ডি গাম লাগিয়ে নেশা করে তারা।
কিছুক্ষণ পরপর ঘ্রাণ নিয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে যায় সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুরা। মা-বাবাহীন ভবঘুরে জীবনযাপন তাদের। কারও বাবা-মা আছে, কারও নেই। কুড়িয়ে পাওয়া প্লাস্টিক, লোহা কিংবা পুরোনো জিনিস বিক্রি করে পেট চালায় তারা। ঘাড়ে চটের বস্তা নিয়ে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ঘুরে বেড়ায় এসব পথশিশু। সারা দিনের সংগৃহীত ভাঙারি বিক্রি করে যে আয় হয়, তা দিয়ে একবেলা খাবার কিনে খায় আর বাকি দুই বেলাই নেশা করে তারা। নেশার এই উপকরণ ‘ড্যান্ডি’ নামেই বেশি পরিচিত। সর্বনাশা এই মাদকের ছোবলে যুবক ও বয়স্কদের পাশাপাশি ‘ড্যান্ডি’ নেশায় এখন পথশিশুরাও আসক্ত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ বদরুদ্দীন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সমাজের একটি বড় সমস্যা পথশিশু, যাদের বেশির ভাগ আবার মাদকাসক্ত। সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এবং সংস্থাগুলো তাদের পুনর্বাসনে কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকাসহ সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত সচেতন করতে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে। রাজধানীর পথশিশুদের মাদকাসক্তি থেকে বের করতে আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি, যাতে মাদক কারবারিরা পথশিশুদের ব্যবহার না করতে পারে। সমাজের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের লাখ লাখ পথশিশুকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের সবার উচিত পিছিয়ে পড়া পথশিশুদের পুনর্বাসন করে ভবিষৎ প্রজন্মকে সুন্দর একটি সমাজ তুলে দেওয়া।
প্রতি বছরের বাজেটে সরকারের একটি নির্দিষ্ট বরাদ্দ থাকে পথশিশুদের নিয়ে। আছে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রও। কিন্তু পথশিশুদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। তারা রয়ে যায় পথের ধারেই। শিশুদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন খরচে হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি। এই অনিয়ম আর দুর্নীতি যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, সরকারের বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন ও দেখভালের অভাবে এসব শিশু জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ ও শিশুশ্রমে, যা সমাজের জন্য অশনিসংকেত।
দেশ গড়ার কারিগর সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে মাদক। মাদকের কারণেই অনেক মা-বাবার বুকফাটা কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যায়। আর এই মারণনেশার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামাজিক কাঠামোয়, আর্থসামাজিক উন্নয়নে, ভারসাম্যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেÑ এক কথায় জীবনের সর্বত্র। অতএব, এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতনতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পদবি সহকারী পরিচালক (চিকিৎসা ও পুনর্বাসন) শেখ মুহাম্মদ খালেদুল করিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তেজগাঁওয়ে ১০ বেডের কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। এটার দেখাশোনা করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদকাসক্ত পথশিশুদের পুনর্বাসনে সমাজকল্যাণ ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলেই কাজ করছে।

 
                             
                                    
                                                                



 সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন