ভারত ও পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনার সময় মঙ্গলবার দিবাগত ভোর রাতে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ভারতের বিএসএফ ১১০ জনকে বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করেছে। খাগড়াছরির মাটিরাঙার তাইন্দং সীমান্ত, কুড়িগ্রামের রৌমারি ও ভূরুঙ্গামারী সীমান্ত দিয়ে পুশইন করেছে বিএসএফ।
এদের মধ্যে খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে পুশইন করা ৬৬ জনই নিজেদেরকে ভারতের গুজরাটের বাসিন্দা বলে দাবি করেছে। তাদেরকে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙার বিজিবি ৪০ ব্যাটালিয়নের হেফাজতে রাখা হয়েছে। বিএসএফের সাথে পতাকা বৈঠক করে তাদেরকে ফেরত পাঠানো হবে। এছাড়া কুড়িগ্রামের রৌমারি ও ভূরুঙ্গামারী সীমান্ত দিয়ে পুশইন করা ৪৪ জনের মধ্যে ৩৬ জনই রোহিঙ্গা।
এ ব্যাপারে বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘খাগড়াছড়ি ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে কিছু পুশইন এর ঘটনা ঘটেছে। তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শুধুমাত্র শতভাগ নিশ্চিত হবার পরই বাংলাদেশি নাগরিক হলে তাদেরকে আইনগত পদ্ধতি অনুযায়ী নিজ জেলায় প্রেরণ করা হবে। নিয়ম ব্যতিরেকে আর কোন পুশইন যেন না করা হয় সেজন্য বিএসএফের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে এবং তীব্র প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করা হয়েছে ও পতাকা বৈঠকের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাকিস্তান এবং ভারত সীমান্তের কোন কিছুর উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব আমাদের কোনো সীমান্তে এখনো পড়েনি। তবে বিজিবি সীমান্তে সম্পূর্ণ সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করছে।
খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানায়, বুধবার ভোর আনুমানিক ৫টার দিকে মাটিরাঙ্গার গোমতি ইউনিয়নের শান্তিপুর সীমান্ত দিয়ে ২৭জন ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে পুশ করা হয়। একই সময় তাইন্দং সীমান্ত দিয়ে ১৫জন এবং পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে ২৪ জনকে জোর করে পুশ করা হয় । গোমতির শান্তিপুর দিয়ে পুশ করা ভারতীয়রা হাজীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। পরে খবর পেয়ে শান্তিপুর বিওপির বিজিবি তাদের আটক করে। নিজেদের ভারতীয় নাগরিক স্বীকার করে গুজরাটের বাসিন্দা বলে তারা জানায়। তারা আরও বলেন, গুজরাট থেকে তাদের আটক করে বিমান ও ট্রেনে করে ত্রিপুরায় নিয়ে আসা হয়। পরে বিএসএফ অস্ত্রেরমুখে জোরপূর্বক তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায়।
তারা আরো জানায়, গত ২৯ এপ্রিল ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় রাজ্য গুজরাটে বাংলাদেশি সন্দেহে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার ব্যক্তিকে আটক করে সেদেশের পুলিশ। আটককৃতরা অধিকাংশই ভারতীয় মুসলিম। এদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশ করার জন্য বিমান ও ট্রেনযোগে ত্রিপুরা রাজ্যে নিয়ে আসা হয়। এদেরই ৬৬জনকে বুধবার ভোরে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশইন করা হয়েছে।
মাটিরাঙ্গার পলাশপুরের বিজিবির ৪০ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো: শাহিনুল ইসলাম বলেন, আটককৃত ভারতীয় নাগরিকদের পুনরায় তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনী বিএসএফের সাথে যোগযোগ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আলোচনা করতে বুধবার বিওপি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠকে বসার জন্য বিএসএফকে আহবান জানানো হয়। একইভাবে বিএসএফের ১১৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের কাছে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে বৃহষ্পতিবার পতাকা বৈঠকের আহবান জানানো হয়েছে।
খাগড়াছড়ির ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, আটক ৬৬ ভারতীয় নাগরিক বিজিবির হেফাজতে আছে। এদের বের্শি ভাগই নারি ও শিশু। ভারতে ফেরৎ পাঠানো বা অন্য কোন সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নের বিজিবির সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে মানবিক কারণে জেলা প্রশাসন তাদের খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবে। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও বিজিবি এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ সমন্বয় বাজয় রাখছে।
কুড়িগ্রাম সীমান্তে পুশইন ৪৪ জন
রৌমারী সংবাদদাতা জানান, রৌমারীতে বিএসএফ বাংলাদেশে পুশইন করেছে ৩০ জনকে। বুধবার ভোরে রৌমারী উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে তাদেরকে আটক করা হয়। আটককৃতরা জানায়, তারা ২০১৮ সাল হতে ২০২২ সাল পর্যন্ত ভারতের আসাম প্রদেশের গোহাটি লকড়া সেন্ট্রাল কারাগারে আটক ছিলেন। পরে তাদের আসাম প্রদেশের গোয়ালপাড়া মাটিয়াল ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রেখে সমস্ত তথ্য প্রমাণ কেড়ে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার দিন শেষে রাতের অন্ধকারে দক্ষিণ শালমারা মাইনকার চর শাহপাড়া ক্যাম্পের বিএসএফ তাদেরকে রৌমারি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশইন করে।
রোহিঙ্গার এই দলটি বাংলাদেশ সীমান্তের ৩ কিলোমিটার ভিতরে আসলে স্থানীয় জনতার সন্দেহ হয় এবং বিজিবিকে খবর দেয়। খবর পেয়ে বিজিবি ঘটনাস্থলে গিয়ে ২১ জন রোহিঙ্গা ও ৯ জন বাংলাদেশীকে উদ্ধার করে রৌমারী সদর ক্যাম্পে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে ৩ জনকে রৌমারী থানা পুলিশ আটক করে। এঘটনায় সীমান্তবাসিদের মাঝে আতংকের সৃষ্টি হয়েছে।
জামালপুর বিজিবি ৩৫ ব্যাটালিয়নের রৌমারী বিজিবি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার সোহেল রানা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আটকদের মধ্যে রোহিঙ্গা নাগরিক ২১ ও বাংলাদেশি নাগরিক ৯ জন। এদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে।
ভূরুঙ্গামারী সীমান্তে ১৪ রোহিঙ্গা পুশইন
ভূরুঙ্গামারী সংবাদদাতা জানান, ভাওয়ালগুড়ি সীমান্তে তিন পরিবারের ১৪ রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও কিশোর কিশোরীকে আটক করে বিজিবি’র কাছে সোপর্দ করেছে স্থানীয় এলাকাবাসী। বুধবার ভোরে উপজেলার চর-ভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের নয়ারহাট বাজারের পাশে রাস্তা হারিয়ে ঘোরাফিরা করছিলো রোহিঙ্গার দলটি। এসময় ফজরের নামাজ শেষে মুসুল্লিরা মসজিদ থেকে বের হয়ে এদের সন্দেহজনক চলাফেরা দেখে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা রোহিঙ্গা বলে পরিচয় দেয় এবং ভোর রাতে তাদেরকে ভারত থেকে বাংলাদেশে জোরপুর্বক পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানায়। খবর পেয়ে বিজিবি রোহিঙ্গাদের আটক করে সোনাহাট বিজিবি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আটককৃতরা হলেন, শহিদুর, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে, জাহিদ আলম, তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে এবং মাহমুদুল্লাহ, তার স্ত্রী রুমানা, দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
কুড়িগ্রাম ২২ বিজিবি’র অধিনায়ক লে.কর্ণেল মোহাম্মদ মাহবুব উল হক জানান, আটককৃতরা সকলেই রোহিঙ্গা।