ঢাকা বুধবার, ২৮ মে, ২০২৫

ক্ষোভ বেড়েছে জুলাই আহতদের

এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২৫, ০১:৩৮ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

ইঞ্জিনিয়ার মো. সৌরভ ইসলাম। নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মাত্র তিন মাস আগে জীবনে জড়িয়েছেন আরেকজনকে। মিরপুর-১০ এর ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে শুরু করেছিলেন সুখের সংসার। নতুন চাকরি-সংসার নিয়ে দিনকাল যাচ্ছিল বেশ আনন্দ-উচ্ছ্বাসেই। বিলাসিতা না থাকলেও সংসারে ছিল না কোনো অভাব-অনুযোগ।

কিন্তু বিধিবাম, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন অন্যায়, অবিচার আর গুম-খুন দেখে ঘরে বসে থাকতে পারেননি সৌরভ। অন্য সবার মতোই নেমেছিলেন রাস্তায়। আন্দোলনের এক বিকেলে পুলিশের ছোঁড়া গুলি লাগে পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে তছনছ হয়ে যায় তার সোনালি স্বপ্ন।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) সাতটি অপারেশন করে পায়ের গুলি বের করলেও ধরা পড়েছে তার নার্ভের সমস্যা। দ্রুত বিদেশে নিয়ে নার্ভের চিকিৎসা না করালে পঙ্গু হওয়ার যাওয়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু বিদেশে নিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নেই সৌরভের পরিবারের।

দেশের বাইরে চিকিৎসা নিশ্চিতের লক্ষ্যে জুলাই ফাউন্ডেশন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অফিস, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ডিসি অফিস ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত তার স্ত্রী। বিদেশে চিকিৎসার জন্য কোনো পথ বের করতে পারেননি এখনো। এমন চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে অনেকেরই। তাই উন্নত চিকিৎসার দাবিতে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষেই চারজন জুলাই আহত বিষপান করেন।

সৌরভের স্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যাদের ডাকে জীবনের মায়া ত্যাগ করে রাস্তায় নেমেছিলেন, তারা এখন ব্যস্ত নতুন রাজনৈতিক দল গঠন এবং নিজেদের আখের গোছাতে। সৌরভের সঠিক চিকিৎসা-পুনর্বাসন নিয়ে কোনো ভাবনা বর্তমান সরকার কিংবা সেই নেতাদের নেই। 

গত দেড় দশকের অনিয়ম, দুঃশাসন, দুর্নীতি ও জনজীবনে সংকটের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের তীব্র বহিঃপ্রকাশ ছিল ২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান। মৃত্যুকে অতি তুচ্ছ জ্ঞান করে অগণিত তাজা তরুণের আত্মদানের ভেতর দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানে আন্দোলন-সংগ্রামের এক ইতিহাস সৃষ্টি হয়। তবে গণঅভ্যুত্থানের ৯ মাস পরও কাক্সিক্ষত চিকিৎসা-সহায়তা থেকে বঞ্চিত রয়েছে জুলাই আন্দোলনের আহতরা। সরকারের প্রতিশ্রুতির দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় চরমভাবে হতাশ তারা। 

আরেক আহত শহিদুল ইসলাম ৪ আগস্ট বিজয়ের ঠিক এক দিন আগে মিরপুর-১০ এ আহত হন। ৯ মাসে ৭টি অপারেশন করা হয়েছে তার। এখনো সুস্থ হননি তিনি। জুলাই আহতদের যে গ্রেড করা হয়েছে সেখানে সি গ্রেডে দেওয়া হয়েছে তাকে, যা কোনোভাবেই মানতে চান না তিনি। তিনি বলেন, আমি কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব না।

আমার পরিবার আমার ওপর নির্ভরশীল। যাদের কথায় রাজপথে নেমেছিলাম তারা আজ নতুন দল করে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। শুনেছি অনেকে শতকোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে অথচ আমরা হাসপাতালের বেডে চিকিৎসার জন্য, খাবার ও ওষুধের জন্য কাতরাচ্ছি। যে জুলাই শহিদ ও আহতদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে বর্তমান সরকার তারাও আমাদের প্রতি উদাসীন। 

গাজীপুর গার্মেন্টসে কাজ করতেন শামিম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমার পরিবারের বউ ছেলে-মেয়েসহ ৫ জন সদস্য আমার ওপর নির্ভরশীল। গত ৯ মাস ধরে হাসপাতালে এতটা করুণ অবস্থা যা প্রকাশ করতে পারব না। সরকার যদি আমাদের পুনর্বাসন না করে তবে আমাদের মরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। 

জুলাই আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজনের কথা উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শামিম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের রক্তের ওপর চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন নিশ্চিত না করে তারা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। শত শত কোটি টাকার মালিক এসব নেতা। আমাদের দু-একবার দেখতে এসেছে গত ৯ মাসে।

আশ্বাস দিলেও কোনো কিছু পূরণ করেনি। আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী রয়েছে গত ৯ মাস ধরে। তার খাবার কিনতে হয় প্রতিদিন। দুজনের খাবারের ব্যবস্থাও এখনো করতে পারেনি তারা। জীবনের মতো পঙ্গু আমি অথচ আমাকে দিয়েছে বি গ্রেড। আবার অনেকে সামান্য আহত হয়ে এ গ্রেডে আছে।

আওয়ামী লীগের অনেক লোকও জুলাই যোদ্ধা হয়েছে বলে আমরা সংবাদ দেখছি। এগুলো লজ্জার, দায়ভার অবশ্যই জুলাই আন্দোলন নেতা এবং সরকারকে নিতে হবে।  ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় আহত হন বিল্পব হোসেন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ৩টা অপারেশন হয়েছে আরও হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের খুবই কষ্ট এজন্য যে, চিকিৎসার জন্য রাস্তায় নামতে হচ্ছে। 

মো. শাহরিয়ার বলেন, আমি ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিকেল ৪টার দিকে আহত হই। আমাকে খুব কাছ থেকে পুলিশ গুলি করে পায়ে। শাহরিয়ারের মা বলেন, কখনো আমার ছেলে পা ঠিক হবে না। আমার ছেলের ক্যাটাগরি দিয়েছে সি, এটা খুবই হতাশাজনক।   এ ছাড়া বেশির ভাগ রোগী ও তার স্বজনদের অভিযোগ, প্রতিটি রোগীর সঙ্গে কমপক্ষে একজনের খাবার দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, নিটোরে যেসব রোগী ভর্তি তার বেশির ভাগই উঠতে পারে না একা। এ ছাড়া বেশির ভাগ রোগীকে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষধ দেওয়া হয় না বলেও জানান তারা। 

এদিকে গণঅভ্যুত্থানে আহতরা ‘চিকিৎসার দাবিতে’ বিভিন্ন সময় আন্দোলনে নেমেছে। ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও তাদের স্বজনরা হাসপাতাল থেকে বিছানাপত্র এনে সড়কে অবস্থান করেছেন কয়েক দফা। তাতেও সঠিক সমাধান পায়নি বলে দাবি করেছেন আহত এবং তাদের স্বজনরা। তারা দাবি করেন, সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে গড়িমসি করছে সরকার। 

জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা ও পরিবারের পাশে দাঁড়াতে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ করা হয়। সরকার থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে আন্দোলনে আহত সবাইকে সুচিকিৎসা দেওয়া হবে। কিন্তু আহতদের অভিযোগÑ যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না।

উন্নত চিকিৎসার দাবিতে ৪ আহতের বিষপান: গত রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক চলাকালে জুলাইয়ের আহত চারজন দাবি নিয়ে ওই কক্ষে প্রবেশ করেন। একপর্যায়ে, আহত চারজন ক্ষুব্ধ হয়ে সেখানেই বিষপান করেন। ধারণা করা হচ্ছে আগে থেকে তাদের কাছে বিষ ছিল।

আহতদের একজন জানান, এই সরকারের কাছ থেকে কিছু পেতে হলে আন্দোলনে নামতেই হয়। শান্তিপূর্ণভাবে কিছু পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে আহত হয়ে ভর্তি থাকা চারজন আজ বিষপান করে। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বর্তমানে তারা সুস্থ আছেন।

আহতদের অভিযোগ ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সংকট: আহতদের প্রধান অভিযোগ, তারা ৯ মাস ধরে হাসপাতালে থাকলেও সরকার তাদের খোঁজ নেয়নি। সেইসাথে, আর্থিক সহায়তা হিসেবে যে টাকা পাওয়ার কথা ছিল তা বিভিন্নজন বিভিন্ন অঙ্কে পেয়েছে, যা নিয়ে সৃষ্ট হয়েছে নতুন ক্ষোভ।  হাসপাতালে ভর্তি থাকলে চিকিৎসা খরচ বাদে আনুষঙ্গিক আরও অনেক খরচ করতে হয় রোগীর পরিবারকে।

অনেকেই বলেছেন, তাদের পরিবারের পক্ষে সেই খরচের ধাক্কা সামলানো আর সম্ভব হচ্ছে না। গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য কেন বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না এই প্রশ্নের উত্তরও খোঁজ করেছেন তারা। এ বিষয়ে জানতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহকে কল করা হলেও কল রিসিভ হয়নি।

চিকিৎসাসেবা না পাওয়া বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকার আরও আন্তরিক হলে চিকিৎসার মান ও সুষ্ঠু সেবা প্রদান সম্ভব হতো। একইসাথে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন তাদের কাজ যথাযথ পালন করতে পারেনি। 

তিনি বলেন, খাবারের বিষয়ে অভিযোগ ছিল রোগী ও স্বজনদের পক্ষ থেকে তবে সেটি পূরণ করা সম্ভব হয়নি, এটি হতাশাজনক। এ ছাড়া আহতদের চিকিৎসাসহ সব দায়িত্ব সরকারের। এগুলো সমন্বয়কদের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সুতরাং, চিকিৎসাসেবা আর্থিক বিষয়সহ পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকারকে আরও বেশি দায়বদ্ধভাবে কাজ করা প্রয়োজন। 

স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ওপর ক্ষোভ

আহতরা বিভিন্ন সময় সুচিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়েছিলেন। সেই সাথে, তারা স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগও চেয়েছেন। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজেও সন্তুষ্ট নন অনেক পক্ষই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এতদিন হয়ে গেছে, তারা কেন ওখানে পড়ে থাকবে? কেন তাদের চিকিৎসা হবে না? যেখানে সরকার পুরো খরচ বহনের কথা বলেছে। বহুদিন পরে তাদের এই ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে। এতদিন পরেও যদি আন্দোলন করতে হয়, তাহলে তা দুঃখজনক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যখন তাদের (আহতদের) দায়িত্ব নিয়েছে, কিন্তু তারা সাহায্য পায়নি, তাহলে বিক্ষোভ করা খুবই স্বাভাবিক।

নাম না প্রকাশের শর্তে নিটোরের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রথম দিকে অনেক দাতা সংস্থা আর্থিক সহযোগিতা করেছিল। বর্তমানে বাইরের এসব সহযোগিতা বন্ধ থাকায় খাবারের মান কমেছে। তবে অনেকেই এখন বাড়িতে যেতে পারেন তারা হাসপাতাল ছাড়ছেন না ভিন্ন উদ্দেশ্যে। আমরা আমাদের স্থান থেকে যথাযথ চেষ্টা করছি। আর যাদের দেশের বাইরে চিকিৎসার প্রয়োজন এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন, আমাদের করণীয় কিছু নেই।