ঢাকা রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৫

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি

ট্রমা কাটাতে পারছে না শিক্ষার্থীরা

শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৫, ০২:৩৬ এএম
মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনায় আহত চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী দিহান দাস শনিবার বার্ন ইনস্টিটিউট থেকে ছাড়পত্র পেয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাসায় ফেরে। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

মাইলস্টোনের ক্লাসরুমের সাদা দেয়াল এখন বিবর্ণ। একসময় যে ক্লাসরুমে সাজানো ছিল সারি সারি বেঞ্চ, সেই কক্ষই এখন ধ্বংসস্তূপ। যে দোলনায় উঠতে শিক্ষার্থীরা করত হুড়োহুড়ি আর প্রতিযোগিতা, সেই দোলনাই এখন যেন এক আতঙ্কের সাক্ষী। সেই আতঙ্কপুরীতে শিক্ষার্থীদের শঙ্কা যেন কাটছেই না। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের পর এখনো ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এমন পরিস্থিতিতে চলতি সপ্তাহেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে ট্রমা আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের সুস্থ করে তোলা এবং মানসিকভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। 

এদিকে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে থামছেই না মৃত্যুর মিছিল। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় গতকাল শনিবারও ঝরে গেল আরও দুটি প্রাণ। একজন সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী জারিফ ফারহান। আরেকজন স্কুল সহকারী মাসুমা। এ নিয়ে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৮-এ। এ ছাড়া গতকাল আয়ান খান ও রাফসি আক্তার রাফিয়া নামে দুই শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়েছে ছাড়পত্র। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি ৪ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন এবং গুরুতর অবস্থায় রয়েছেন আরও ৯ জন।  

বিমান বিধ্বস্তের ৫ পাঁচ দিন পর গতকালও উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের সামনে সাধারণ মানুষের জটলা দেখা যায়। বেশির ভাগই গেটের ফাঁকা অংশ দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছেন অনেকেই। তবে এদিন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের ভেতরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়নি। স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে বাবা-মায়ের হাত ধরে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেখা গেছে। তবে সাংবাদিকসহ উৎসুক লোকজনকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি গতকালও। 
জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনার পাঁচ দিন পর না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহকারী মাসুমা। গতকাল সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। একই দিনে সকাল ৯টা ১০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী জারিফ ফারহান। তার শরীরের ৪০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, মাসুমার শরীরের প্রায় ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল। গত পাঁচ দিন ধরে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। তবে তার অবস্থা শুরু থেকেই আশঙ্কাজনক ছিল। এ ছাড়া জারিফের শরীরের প্রায় ৪০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছিল।

জারিফের বাবা হাবিবুর রহমান ও মা রাশেদা ইয়াসমিন সন্তানের জন্য প্রার্থনায় ছিলেন, কিন্তু আজ সেই প্রার্থনা থেমে গেল চিরতরে। জারিফের বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, ২২ তারিখ সকাল পর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা বলছে। কথার মধ্যে একসময় দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওদের চার বন্ধুর কথা উঠে আসে। ওরা চার বন্ধু খুবই ঘনিষ্ঠ..। এ কথা বলেই হাউমাউ করে কেঁদে দেন হাবিবুর রহমান। 

জানা গেছে, মাহতাব, আয়ান, জারিফ আর আয়মান ছিল খুবই কাছের বন্ধু। এর মধ্যে দুই দিন আগেও মারা গেছে মাহতাব, আরেক বন্ধু আইসিইউতে। 

মাসুমার স্বামী সেলিম জানিয়েছিলেন, মাইলস্টোন স্কুলে আয়ার কাজ করতেন তার স্ত্রী। তাদের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তুরাগের নয়ানগর এলাকায় থাকতেন মাসুমা-সেলিম দম্পতি।

ট্রমা এখনো কাটেনি: মাইলস্টোন স্কুলের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসের ইংলিশ শাখার অধ্যক্ষ ক্যাপ্টেন (অব.) জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ক্যাম্পাসে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় তদন্ত কমিটি কাজ করছে। শিক্ষার্থীদের ট্রমা এখনো কাটেনি। তাদের জন্য ক্যাম্পাসে কাউন্সেলিংয়ের জন্য তিনজন রয়েছেন। শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। এমন পরিস্থিতিতে চলতি সপ্তাহের ক্লাস-পরীক্ষা চালু করা সম্ভব নয়। কবে নাগাদ চালু হবে তা নিয়েও কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে আগামী সপ্তাহে ক্লাস চালু হতে পারে।

গতকাল বেলা ১১টার দিকে গলায় স্কুলের পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র জুনায়েদ সিদ্দিকী। আধাঘণ্টা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেলা সাড়ে ১১টায় বের হয় জুনায়েদ। এ সময় জুনায়েদ সাংবাদিকদের জানায়, ওই দিন বিমান দুর্ঘটনার সময় বিকট শব্দ হয়েছিল। মনে হয়েছিল কানের পর্দা ফেটে যাবে। আতঙ্কে সবাই ছোটাছুটি করি। একপর্যায়ে শান্ত হয়ে স্কুলের যে ভবনটিতে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে সেখানে আসি। দেখি শিশু শিক্ষার্থীদের হাত-পা ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। বহু শিক্ষার্থী আগুনে পুড়ে গেছে। এমন করুণ দৃশ্য বলে বোঝানো যাবে না। এখন রাতে ঘুমাতে গেলে এই দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে ক্লাস-পরীক্ষা দেব মাথায় আসে না।

ওই স্কুলের জিহান নামে এক শিক্ষার্থী জানায়, বিমানের শব্দ শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথমদিকে প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম কখন বিমান আসবে, আর আমরা বন্ধুদের নিয়ে মাঠে গিয়ে সেটা দেখে উল্লাস করব। বিমানের শব্দ কখনো আতঙ্কের কিছু ছিল না, বরং ছিল আনন্দের উৎস। কিন্তু চোখের সামনে যখন যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্ত হলো, তখন থেকে বিমানের শব্দ পেলেই মনে হয় এই বুঝি আমাদের ওপর এসে পড়ল।

ট্রমা কাটাতে কাউন্সেলিংয়ের উদ্যোগ: যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত ও ট্রমায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের সুস্থ করে তোলা এবং মানসিকভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। 

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ি শাখার প্রধান শিক্ষক খাদিজা আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখনই দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাস খোলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থী এখনো হাসপাতালে মৃতের সঙ্গে লড়ছে। সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে এখন আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি অসুস্থ বাচ্চাদের চিকিৎসা ও প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীকে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করায়।

তিনি বলেন, আমাদের প্রতিটি শিক্ষার্থী ট্রমাটাইজড হয়ে আছে। তাদের মানসিকভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাউন্সেলিং অত্যন্ত জরুরি। তাই আমরা প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাউন্সিলরের মাধ্যমে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, আমরা সব শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। যারা মারা গেছে, তাদের পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। আর যারা বেঁচে আছে, তাদের জন্য আমরা চূড়ান্ত যুদ্ধ করব। যাতে তাদের সুস্থ করে ফিরিয়ে আনতে পারি।

ছাড়পত্র পেয়েছে দুই শিক্ষার্থী: বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ ২ শিক্ষার্থীকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় গতকাল দুপুরের পর তাদের হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়।

গতকাল বিকেলে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, সকালে মাসুমা বেগম (৩৬) ও জারিফ ফারহান (১৩) নামে পরপর দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় দুইজনকে আজ ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এরা হলো স্কুলটির শিক্ষার্থী আয়ান খান (১২) ও রাফসি (১২)।

তিনি বলেন, এখন ৩৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এদের মধ্যে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে ৪ জন। যাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। সিভিয়ার ক্যাটাগরিতেÑ অর্থাৎ এদের চেয়ে একটু কম গুরুতর অবস্থায় রয়েছে ৯ জন। বাকিরা অন্য ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে। আগামী এক সপ্তাহে আরও অন্তত ১০ জনকে পর্যায়ক্রমে ছাড়পত্র দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। চিকিৎসায় আমাদের কী কী ওষুধ দরকার সেগুলো আমরা আগে থেকেই কিনে রেখেছি।

পরিচালক নাসির উদ্দীন জানিয়েছেন, দগ্ধ রোগীদের আলাদা আলাদা ক্যাটাগরিতে ভাগ করে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। এই মুহূর্তে সিঙ্গাপুর ও চীনের চিকিৎসকদল কাজ করছে। তাদের পরামর্শ মতোই রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।