চলতি বছরেও চালু হচ্ছে না হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল। বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তরফ থেকে বারবার আশার বাণী শোনানো হলেও টার্মিনালটি চালু হওয়া নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কবে নাগাদ এটি চালু হতে পারে, তা কোনো পক্ষই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। সদ্যবিদায়ী বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া একেক সময় একেক আশ্বাস দিলেও বাস্তবতায় তা ফিঁকে বলে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তিনি একবার বলেছিলেন, জুন-জুলাইয়ে টার্মিনালটি চালু হবে।
আরেকবার তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, যেকোনো মূল্যে ডিসেম্বরে চালু হবে। আকস্মিকভাবে তিনি বদলি হয়ে গেলে পুরো প্রক্রিয়াটিই থমকে দাঁড়ায়। এখন এটি চালুর বিষয়টি পুরোপুরি ভবিতব্যনির্ভর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেবিচকের কেউই নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না।
রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়ে এলেও পূর্ণতা পায়নি তৃতীয় টার্মিনাল। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি স্থাপন, ক্যালিব্রেশন ও টেস্টিং বাকি। টার্মিনারের পূর্বদিকের কাজ এখনো শেষ হয়নি। তা ছাড়া টার্মিনাল পরিচালনায় জাইকার সঙ্গে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়নি। এই চুক্তি হওয়ার পর জনবল সংগ্রহের প্রয়োজন দেখা দিবে। টার্মিনাল পরিচালনায় জনবল লাগবে কম করে হলেও ৬ হাজার। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা টার্মিনাল সচল রাখতে এই জনবলের কোনো বিকল্প নেই। উপরন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজন হবে ৪ হাজার জনবল। এরপর এই জনবলকে প্রশিক্ষিত করতে সময় নেবে বেশ কয়েক মাস। ফলে এমন প্রেক্ষাপটে চালুর বিষয়টি আগেভাগেই নির্ধারণ করাটা অনেকটা দুরূহই বলা যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনারের সফট লঞ্চিং হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। ৩ তলাবিশিষ্ট টার্মিনালটির আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। যাত্রী ধারণ সক্ষমতা বছরে ১৬ মিলিয়ন। টার্মিনারের পার্কিংয়ে প্রায় ১২৩০টি গাড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকবে। উড়োজাহাজ পার্কিংয়ে বে থাকবে ৩৭টি। আগমনী যাত্রীদের জন্য লাগেজ বেল্ট থাকবে ১৬টি। বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বর্গাকার আয়তনের একটি কাস্টম হল থাকবে। সেখানে থাকবে ৬টি চ্যানেল। চেকইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি। বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে ৬৬টি। আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৫৯টি। এর মধ্যে ভিভিআইপি ৩টি। প্রথম পর্যায়ে বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে ১২টি। পরবর্তীতে আরেকটি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় যুক্ত করা হবে আরও ১৪টি ব্রিজ। বর্তমান টার্মিনালের সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনারের কোনো সংযোগ থাকবে না। এটি হবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
তবে পরবর্তীতে করিডোর নির্মাণ প্রকল্পের পরিকল্পনায় রয়েছে। নতুন এই টার্মিনালে ট্রানজিট যাত্রীদের জন্য একটি বড় লাউঞ্জ থাকবে। বছরে ৪০ লাখ যাত্রীসেবার সক্ষমতা থাকবে এটির। ভিআইপি যাত্রীদের জন্য থাকছে ৩ হাজার ৬৩০ বর্গমিটার এলাকা। টার্মিনালটি চালু হলে যাত্রীদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে হাজী ক্যাম্প থেকে উত্তরা পর্যন্ত পাতাল রেল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের লক্ষ্যে এয়ার লাইন্স লাউঞ্জ, ডে-রুম, মুভি লাউঞ্জ, শিশুদের জন্য প্লে-জোন এবং ফুডকোর্টও থাকছে। তবে এগুলো এখনো বলতে গেলে কাগজে-কলমেই। বাস্তবে এগুলো চালুর নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারছেন না।
এদিকে চলতি বছরেও টার্মিনালটি চালু অনিশ্চিত হওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে বেবিচকের কিছু কর্মকর্তা ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তনকেই দুষছেন। তারা বলছেন, ঘন ঘন পিডি পরিবর্তন যেকোনো প্রকল্পের চলমান গতি শ্লথ করে দেয়। সব মিলিয়ে চলতি বছরে যে তৃতীয় টার্মিনাল চালু হচ্ছে না- এটি মোটামুটি নিশ্চিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তৃতীয় টার্মিনারের ব্যয়বরাদ্দ ধরা হয় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পায় জাইকাসহ তিন প্রতিষ্ঠান সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম। এই তিন প্রতিষ্ঠান হলোÑ জাপানের মিতসুবিশি করপোরেশন, ফুজিতা করপোরেশন এবং কোরিয়ার স্যামসাং টিঅ্যান্ডটি। এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে বেবিচকের চুক্তি হয় ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি।
চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজ বাস্তবায়নের মেয়াদ ৪৮ মাস। চুক্তিমূল্য ২০ হাজার ৫৯৮ কোটি ৬০ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯৯ টাকা (সিডি ভ্যাটসহ)।
তৃতীয় টার্মিনাল চালুর বিষয়ে বেবিচকের বর্তমান চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মোস্তফা মাহমুদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সবার সহযোগিতায় বিরাজমান কিছু সমস্যা নিরসনের চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া কিছু চুক্তি সম্পাদন বাকি রয়েছে। চুক্তিটি হয়ে গেলে বলা যাবে কবে নাগাদ এটি চালু হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :