রবিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


বাসস

প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৫, ০৮:২৭ এএম

হল গেটের তালা ভেঙে ১৪ জুলাই রাতেই হাসিনাকে লাল কার্ড দেখিয়েছিলাম: সানজিদা তন্বি

বাসস

প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৫, ০৮:২৭ এএম

সানজিদা আহমেদ তন্বি।     ছবি- সংগৃহীত

সানজিদা আহমেদ তন্বি। ছবি- সংগৃহীত

২০২৪ সালের ১৫ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় নৃশংস হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এ হামলায় আহতদের একটি বড় অংশ ছিল নারী শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদেরকে টার্গেট করে পিটিয়েছে।

এ হামলায় আহত এক নারী শিক্ষার্থীর রক্তাক্ত চেহারার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক ভাইরাল হয়। এ ছবিতে ছাত্রলীগের বর্বতার চিত্র তুলে ফুটে ওঠে এবং এটি দেশজুড়ে মানুষের মনে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়।

ছাত্রলীগের হামলায় রক্তাক্ত ওই শিক্ষার্থীর নাম সানজিদা আহমেদ তন্বি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। এ বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি এখন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়ন করছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।

সানজিদা আহমেদ তন্বির বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায়। তার বাবার নাম মেজবাহউদ্দিন আহমেদ, মায়ের নাম সাহানারা বেগম। স্থানীয় এক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি শেষে তিনি মাদারীপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন। সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরের সামনে ছাত্রলীগের হামলায় রক্তাক্ত হন তন্বি। তার ওই রক্তাক্ত ছবি হাতে নিয়ে অনেকে আন্দোলনে নামেন।

সানজিদা আহমেদ তন্বি জানান, ওই রক্তাক্ত ছবি দিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন বানিয়ে তার কলেজের শিক্ষার্থীরা ১৮ জুলাই আন্দোলনে নেমেছিল। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মাদারীপুরে শিক্ষার্থীরা সেদিন অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে রাস্তায় নামে। সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় দীপ্ত দে (২২) নামে এক শিক্ষার্থীসহ অনেকে আহত হন। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ ও পুলিশ আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দিলে দীপ্ত দে সেখানের এক লেকে ঝাঁপ দেন। পরে তিনি সেখানে ডুবে মারা যান। দীপ্ত দে মাদারীপুর সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

তন্বি বলেন, ‘দীপ্ত দে’র প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও স্মরণ আজীবন থাকবে। আমার ওই রক্তাক্ত ছবি আরো অনেক মানুষকে আন্দোলনে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছিল বলে জেনেছি। শহীদ ওয়াসিম ওই রক্তাক্ত ছবি শেয়ার করেছিল। সেটা আমি ১৭ জুলাই দেখতে পাই। এসব দেখে আমার আহত হওয়া নিয়ে আর কখনো খারাপ লাগা কাজ করেনি, বরং গর্ববোধ হয়েছে।’

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সানজিদা আহমেদ তন্বি সেই ঘটনাসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশার নানা দিক তুলে ধরেন।

বাসস : ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে আপনি কখন, কীভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : জুলাইয়ের শুরু থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। তবে ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা যখন শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটুক্তি করে তখন আন্দোলন বেগবান হয়। ওই দিন রাত ১০ টার দিকে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদে হলগুলোতে স্লোগান শুরু হয়। রাত ১১টার দিকে আমাদের রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা হল গেইটে এসে জড়ো হই। তখন অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরাও রাজু ভাস্কর্যের সামনে আসতে শুরু করে। আমাদের হলের গেইট তালাবদ্ধ করে রেখেছিল। আমরা রাত সাড়ে ১১ টার দিকে তালা ভেঙে হল থেকে বেরিয়ে আসি। সেদিন আমরা নারী শিক্ষার্থীরা ড্রেস চেঞ্জ করারও সময় পাইনি। হলের ভেতরে যে সাধারণ পোশাক পরা হয়, সেগুলো পরিহিত অবস্থায় আমরা বেরিয়ে আসি। হাঁড়ি-পাতিল, বাসন, চামচ ইত্যাদি হাতের কাছে যে যা পেয়েছে, সাউন্ড করার জন্য তা নিয়ে সবাই বের হয়। চারদিক থেকে শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হয়। আমরা নারী শিক্ষার্থীরা সামনের সারিতে ছিলাম।

বাসস : ছাত্রলীগ দীর্ঘদিন ধরে হলগুলোতে আধিপত্য বজায় রেখেছিল। ওই সময় আপনারা যখন হল গেইটের তালা ভেঙে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন, তখন ছাত্রলীগ বাধা দেয়নি? সেদিন ছাত্রীদের মধ্যে কীভাবে এ সাহস জন্মেছিল?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : ওই রাতে ছাত্রলীগও জড়ো হয়েছিল। তবে আমাদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তারা আমাদের ওপর আক্রমণ করার সাহস পায়নি। যৌক্তিক দাবি আদায়ে আন্দোলন করার কারণে যদি ‘রাজাকার’ নামক ঘৃণ্য ট্যাগ দেওয়া হয়, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। শেখ হাসিনার কটুক্তির প্রতিবাদে ওইদিন আমরা স্লোগান দিই ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। এই স্লোগান ছিল শেখ হাসিনার দেওয়া ট্যাগকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করা। ওই দিনই মূলত শেখ হাসিনাকে লাল কার্ড দেখিয়ে দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশেপাশের প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা। এই স্লোগানের অর্থও তারা তখন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। এ স্লোগানের কারণে তারা আমাদের ‘স্বঘোষিত রাজাকার’ বলেছে। অথচ ব্যাপারটা ছিল, আমরা রাজাকর নই, সেটা ছিল শেখ হাসিনার কটুক্তির প্রতিবাদ।

দীর্ঘক্ষণ রাজু ভাস্কর্যের সামনে স্লোগান ও বিক্ষোভ শেষে আমরা হলে ফিরে যাই। কিন্তু ছাত্রলীগ নেত্রীদের হামলার ভয় বা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না। কারণ, সবার উদ্দেশ্য ছিল এক। সবার মধ্যে একটা অন্য রকম স্পিরিট কাজ করেছিল। আন্দোলনকারীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করায় শেখ হাসিনার কথা শিক্ষার্থীরা মেনে নিতে পারেনি। এ কারণেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। আমরা গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। এই স্লোগানই ছিল তাকে প্রত্যাখ্যানের লাল কার্ড। আমরা বলেছি, আমরা দেশের দায়িত্বশীল নাগরিক, রাজাকারের নাতিপুতি না। রোকেয়া হল তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা সব সময় অধিকার সচেতন। সে কারণে শেখ হাসিনার ওই দাম্ভিক ও বিদ্রুপপূর্ণ কথা মেনে নিতে পারেনি মেয়েরা।

বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন বিষয়টা আপনাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : মূলত বিবেকের তাড়নায় আমি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। অন্যায় দেখলে চুপ থাকা আমার স্বভাব নয়। কোনো স্বার্থ বা কোনো চাওয়া-পাওয়ার জায়গা থেকে আমি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিনি। তখন মনে হয়েছে, এ আন্দোলন যৌক্তিক। সেই জায়গা থেকেই আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষকে নিষ্পেষণ করে আসছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকেও শুরু থেকে তাচ্ছিল্য করেছিল তারা। বিষয়টা এমন মনে হয়েছে, তারা যা বলবে, তা মেনে নিতে বাধ্য হবে জনগণ। সেই ক্ষোভের জায়গাটাও ছিল। দেশের প্রয়োজনে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি। সফল হওয়ার পরও নিজেকে ওভাবে প্রচার করিনি। ভাইরাল হওয়ার পরও কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ খুঁজিনি। আমার কিন্তু বিসিএস বা এই ধরনের সরকারি চাকরির প্রতি ইচ্ছা ছিল না, এখনো নেই। অন্যায় দেখে চুপ থাকতে পারি না। বৈষম্যমূলক কোটা প্রথার মাধ্যমে সরকার শিক্ষার্থীদের ওপর অবিচার করেছিল। আমরা তখন কোটার বিলুপ্তি চাইনি, সংস্কার চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করেননি, বরং আমাদের তাচ্ছিল্য করেছেন। ফলে তার নির্মম পতন হয়েছে।

বাসস : ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। এদিন ছাত্রলীগের হামলায় আপনি রক্তাক্ত হয়েছেন। আপনার রক্তাক্ত ছবি সারাদেশে ভাইরাল হয় এবং এটা মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলুন।

সানজিদা আহমেদ তন্বি : ১৫ জুলাই দুপুর থেকে আমরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিই। ওইদিন ছাত্রলীগও একই স্থানে কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। তার মানে, হামলার আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। তবে আন্দোলনকারীরা নাছোড়বান্দা ছিল। আমরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকি। বিকেল তিনটার দিকে জানতে পারি, বিজয় একাত্তর হলে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখা হয়েছে। তারা আন্দোলনে যোগ দিতে চায়, কিন্তু ছাত্রলীগ তাদের বের হতে দিচ্ছে না। পরে আমরা তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য হলপাড়ার দিকে রওনা দিই। সূর্যসেন হলের সামনে গিয়ে দেখতে পাই, বিজয় একাত্তর হলের সামনের রাস্তায় ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। সেখানে অনেকে আহত হন। কারো নাক দিয়ে রক্ত ঝড়ছে, কেউ লাঠির আঘাতে আহত, ইট-পাটকেলের আঘাতে কারো মাথা ফেঁটে গেছে। তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এক পর্যায়ে হলপাড়ার দিক থেকে আমাদের ধাওয়া দেয় ছাত্রলীগ। আমরা রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনে দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করি। এক পর্যায়ে আমরা ভিসি চত্বরের সামনে গেলে বিভিন্ন দিক থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমাদের ওপর নৃশংস হামলা করে। তারা ইট-পাটকেল, লাঠি পেটা, এমনকি দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি হামলা করে।

বাসস : ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ হাসপাতালে গিয়েও আহতদের ওপর হামলা করে। আপনি ওই সময় কোথায় চিকিৎসা নিয়েছেন? তখন কোনো ধরনের সমস্যায় পড়েছিলেন কিনা?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : হাসপাতালে আসার পর আমি কিছুই বুঝতেছিলাম না। হাসপাতালে একের পর এক আহতরা আসছিল। আমার তিন বান্ধবী স্বর্ণ, তন্নি আর সুপ্রীতি আমাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌঁড়ঝাঁপ করে। তখনো আমার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছিল না। আমাকে অপরাশেন থিয়েটার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার চেয়ে গুরুতর রোগী আরো অনেকে ছিল। তাই অপেক্ষা করতে হয়েছে। পরে আমার সেলাই শুরু হয়। ছয়টি সেলাই লেগেছে ক্ষতস্থানে। চোখের ঠিক নিচে আক্রান্ত হওয়ায় জায়গাটা একটু সেন্সিটিভ ছিল। হাসপাতালে থাকতেই শুনতে পাই, ছাত্রলীগ হাসপাতালেও হামলা করতে আসছে। পরে তড়িঘড়ি করে পলাশীতে আমার বান্ধবীর বাসায় যাই। হাসপাতালের উল্টো গেইট দিয়ে আমাদের বের হতে হয়েছিল। একটু পর শুনি ছাত্রলীগ হাসপাতালেও এসে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে। তার মানে, আর কিছুক্ষণ দেরি হলে আমিও দ্বিতীয়বার হামলার শিকার হতাম।

বাসস : আহত হওয়ার পরও কি আপনি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন? তখন কোথায়, কী অবস্থায় ছিলেন?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : ১৫ জুলাই আহত হওয়ার পর আমি বাসায় বন্দি হয়ে পড়ি। চোখের নিচে আক্রান্ত হওয়ার কারণে চশমা পরতে পারছিলাম না। আর চশমা ছাড়া আমার দেখার সমস্যা হয়। তারপর এ সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছিল। আমার পরিবারের কাছে বারবার আমার রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। তার মানে, কোনো একটা যোগসূত্র পেলেই যাতে আমাকে ফাঁসানো যায়। পরবর্তীতে ড্রেসিং করার জন্য লুকিয়ে ভয়ে ভয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। ওই সময় আমি কারো হেল্প ছাড়া চলতে পারতাম না। চোখের নিচে আঘাত পাওয়ার কারণে আমি ফোনের দিকে তাকিয়েও থাকতে পারতাম না। সব মিলিয়ে একটা ঘোর বা ট্রমার মধ্যে ছিলাম। তাই ওই সময়ে রাস্তায় নামতে না পারার জন্য এখনো আমার আফসোস হয়। তবে ১৫ জুলাইয়ের পরের দুইদিন রোকেয়া হলসহ ক্যাম্পাসের সবার ও পরে পুরো বাংলাদেশের মানুষের অবস্থান আমাকে গর্বিত করেছে।

বাসস : আপনার রক্তাক্ত চেহারা দেখার পর বাবা-মা বা পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : জুলায়ের শুরু থেকে আন্দোলনে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে কখনো বাধার সম্মুখীন হইনি। তবে বাবা-মা আমাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমার ওপর হামলার খবরে আম্মু অনেক প্যানিকড হয়েছিলেন। তারা আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।

বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলন এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এই গণঅভ্যুত্থান কেন অপরিহার্য ছিল?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে দেশের মানুষকে নিষ্পেষণ করে আসছিল। তারা কাউকে তোয়াক্কা করত না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকেও শুরু থেকে তাচ্ছিল্য করেছিল। বিষয়টা এমন ছিল, তারা যা বলবে, তা মেনে নিতে বাধ্য হবে জনগণ। এক পর্যায়ে জনগণ তাদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে। ১৫ জুলাইয়ের পর থেকে দেশে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে থাকে। মানুষ রক্ত আর লাশ দেখে রাস্তায় নেমে আসে। আসলে এত লাশের পর আর শান্তি-সমঝোতা হয় না। তাই শেখ হাসিনার পতন ছিল অনিবার্য। পরে রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার পতন হয়েছে।

বাসস : আপনার ছবি যখন মানুষ প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করত, তখন কেমন লাগতো?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : আহত হওয়ার পর আমি চোখে ভালোভাবে দেখতে পেতাম না। একে তো শরীর অসুস্থ, তারপর এক চোখে কিছু দেখতে পাই না। এর মধ্যে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ফোন আসতে থাকে। ভড়কে যাই আমি। একটা ট্রমার মধ্যে ছিলাম। পরে দেখেছি, আমার এই রক্তাক্ত ছবি নিয়ে আন্দোলনে নামে আমার নিজ জেলার মানুষ। আমার ওই ছবি দিয়ে ব্যানার বানিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল আমার কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেখানেও স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলা চালায়। আমাদের কলেজের শিক্ষার্থী দীপ্তসহ অনেকে আহত হন। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ ও পুলিশ ধাওয়া দিলে দীপ্ত দে সেখানের এক লেকে ঝাঁপ দেন। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার প্রতি আমার সব সময় শ্রদ্ধা কাজ করে। এছাড়াও পরবর্তীতে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, এই ছবির কারণে মানুষ আন্দোলনে নামতে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সত্যি বলতে, তারপর থেকে আমার আহত হওয়া নিয়ে একটুও খারাপ লাগেনি, বরং গর্ববোধ হয়েছে।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীদের ভূমিকা কেমন ছিল? আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারী শিক্ষার্থীরা অসীম সাহস ও নেতৃত্বের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীরা ছিলেন সম্মুখ সারিতে। যার কারণে ছাত্রলীগ সহজে আন্দোলন দমন করতে পারেনি। নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা দেশে-বিদেশে এই আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরি করেছে। নারী শিক্ষার্থী স্লোগানে মুখর রেখেছেন রাজপথ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নারী শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশ নেন। নারী শিক্ষার্থীদের সাহসিকতা, নিষ্ঠা ও অগ্রণী অংশগ্রহণ না থাকলে এই আন্দোলন এত দ্রুত এবং এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ত না। আন্দোলনের দিনগুলোতে ছাত্রী হলগুলো যেন একেকটি প্রতিরোধের দুর্গে পরিণত হয়েছিল। তাদের প্রত্যয় ও অংশগ্রহণই প্রমাণ করেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে নারীরাও অগ্রণী।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কোন ঘটনা আপনার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছিল? যে স্মৃতি এখনো নাড়া দেয়, সে সম্পর্কে জানতে চাই।

সানজিদা আহমেদ তন্বি : আসলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যেকটি স্মৃতিই আমার মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছে। আবু সাঈদের সাহসিকতা কিংবা মুগ্ধর আত্মত্যাগ ছিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঘটনা। ১৫ জুলাই আহত হয়েছিলাম, ওই দিনটা আমার জীবনে ভীষণ স্মৃতিময়। এ বছর ১৫ জুলাই সেই ঘটনার বর্ষপূর্তির দিনে আমি সারাদিন একেবারে মনমরা হয়ে ছিলাম। কেমন যেন একটা অস্থিরতা অনুভব করেছিলাম। মাদারীপুরের মতো আওয়ামী অধ্যুষিত অঞ্চলে আন্দোলন ও পরবর্তীতে দীপ্ত দে’র মৃত্যু আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে। আমার আহত হওয়ার ছবি পোস্টার বানিয়েই ওরা আন্দোলনে নেমেছিল। ওয়াসিমের পোস্ট আমার নজরে এসেছিল মনে হয় ১৭ জুলাই। আমার ছবি শেয়ার করেছিল সে। এগুলো ভাবলে একইসাথে গর্ব ও খারাপ লাগা কাজ করে।

বাসস : ছাত্রলীগের নিপীড়ন ও অপরাজনীতির কারণে ১৫ জুলাই রাতে শিক্ষার্থীরা রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের দাবি তুলেছিলেন। সেই ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী? ছাত্ররাজনীতিতে এখন কী ধরনের পরিবর্তন চান?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : ছাত্রলীগের নিপীড়ন ও নোংরা রাজনীতির কারণে শিক্ষার্থীরা অতিষ্ঠ হয়ে রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চেয়েছিল। শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হল থেকে বিতাড়িন করেছিল। ৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চলছে। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকুক সমস্যা নেই, কিন্তু অপরাজনীতি যাতে না হয়। ডাকসু সচল হোক। শিক্ষার্থীরা তাদের ম্যান্ডেট দেবে। যারা ইতিবাচক কাজ করবে, শিক্ষার্থীরা তাদের দিকেই ঝুঁকবে। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ছাত্র-সংগঠনগুলো কাজ করুক, এটাই আমাদের চাওয়া।

বাসস : আপনাদের রক্ত দেশকে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা থেকে মুক্ত করেছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। জুলাইয়ের সময় যে ঐক্য ছিল, সেটি ধরে রেখে যাতে দেশের কল্যাণে সবাই মনোযোগ দিই, সেটি আমার চাওয়া। পাশাপাশি, নারীদের সব রকমের অধিকার যাতে রক্ষা করা হয়, সেটিও কামনা করি। দেশে ধর্ষণ ও ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা দেখতে চাই না। বিভিন্ন মঞ্চ থেকে নারী অবমাননামূলক বক্তব্য শুনতে চাই না। এই অভ্যুত্থানে ধনী-গরীব, শহর কিংবা গ্রামের সব মতাদর্শের তথা সব অঙ্গনের মানুষের অবদান আছে। কাউকে যেন আমরা অবজ্ঞা করে কথা না বলি।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সুফল পেতে রাষ্ট্রের করণীয় কী? দেশকে কীভাবে আরো সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়?

সানজিদা আহমেদ তন্বি : জুলাই গণঅভ্যুত্থান সকলের সম্মিলিত অর্জন। আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগকে সবার সম্মান করা উচিত। ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থকে প্রাধ্যান্য না দিয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। দেশে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরত আনতে হবে। সব বিভাগের জবাবদিহিতা প্রয়োজন। মানুষের কথা বলার বা প্রশ্ন তোলার যে চর্চা ৫ আগস্টের পর চালু হয়েছে, সেটি অব্যাহত থাকতে হবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!