আট বছর পেরোলেও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের কোনো পথ এখনো খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ। যারপর নাই চেষ্টা করেও শুরু করা যায়নি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। বরং দিন দিন যেন প্রলম্বিত হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিগত সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। চেষ্টা করে যাচ্ছে বর্তমান সরকারও। কিন্তু ফল একদমই শূন্যের কোটায়।
প্রত্যাবাসন দূরের কথা, উলটো এখন মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি বাকি রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করছে। তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর হামলা চালাচ্ছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। এ কারণে প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় নিচ্ছে।
এমন এক বাস্তবতায় বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অনেকেই এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে প্রবেশ করতে দেওয়া চরম ভুল হয়েছিল বলে মত দিচ্ছেন।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল। কিন্তু প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে, তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি তখন। পরে প্রত্যাবাসনও শুরু করা যায়নি। সে সময় নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ আট দফা দাবি জানিয়েছিল রোহিঙ্গারা।
ওই সময় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মিয়ানমারবিষয়ক দূত ইয়াংহি লি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি স্বেচ্ছায় হতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। এরপর ২০২৩ সালের অক্টোবরে চীনের মধ্যস্থতায় এক হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে প্রকল্প নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পৃথক পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করে ডিসেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। এ অবস্থায় গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
এই সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক নানা ঘটনাপ্রবাহ এবং মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক মনোযোগও হারিয়েছে। কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে কমেছে তাদের জন্য মানবিক সহায়তা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি। তাদের সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক তহবিলেরও তীব্র সংকট চলছে। এ সুযোগে অনেক রোহিঙ্গা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে বর্তমান নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। ইতিমধ্যে সীমান্ত পেরিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের মধ্যে গত জুন পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছেন এক লাখ ২১ হাজার। আর অন্যরা নিবন্ধন ছাড়াই ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছেন। নতুন করে আসা এসব রোহিঙ্গার বেশির ভাগই নারী-শিশু। সবমিলিয়ে ১৪ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। কিন্তু গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। এটি বড় উদ্বেগের কারণ।
কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের আসার আট বছর পেরিয়ে গেছে। এত বছরে একজনকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। দীর্ঘ মেয়াদে লাখ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান স্থানীয় বাসিন্দাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের ফেরত পাঠানো না গেলে ভবিষ্যতে স্থানীয়দের জন্য ভয়াবহ কিছু অপেক্ষা করছে। প্রত্যাবাসন যত বিলম্ব হচ্ছে, ততই স্থানীয়দের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। একসময় রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘাত তৈরি হবে।
দীর্ঘ মেয়াদে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার অবস্থান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের কারণে সেখানের পরিবেশ পরিস্থিতি নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়েছেন। কারণ তারা মনে করেন, তারা ফেরত গেলে সংকট সমাধান এবং স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবনযাপন সহজ হবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন