বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এবারে জাতিসংঘের ৮০তম অধিবেশনে বাংলাদেশের হয়ে ভাষণ দেন নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূস। অধিবেশনের ভাষণে প্রতিনিধিদের মাঝে শান্তিতে একমাত্র নোবেল বিজয়ী হওয়ায় ড. ইউনূসের বক্তব্য আলাদা করে গুরুত্ব পেয়েছে। তার ৪৬ পৃষ্ঠার লিখিত ভাষণে জাতীয় নির্বাচন, রোহিঙ্গা সংকট, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, বিশ্বব্যাপী ইসলামফোবিয়া, পারমাণবিক অস্ত্র এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ইউনূস বক্তব্য শুরু করেন জাতিসংঘের অবদানের প্রশংসা দিয়ে। তবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরেন। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের সময় কেমন রাষ্ট্র কাঠামো তিনি চেয়েছিলেন। তিনি ১১টি কমিশন গঠন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ও জুলাই সনদের বাস্তবতার ওপর জোর দিয়ে বলেন, এমন রাষ্ট্রকাঠামোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে কেউ স্বৈরাচারী হতে পারবে না। একই সঙ্গে তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেন।
ভঙ্গুর অর্থনীতির একটি রাষ্ট্রকে কীভাবে সামলে নিয়েছেন তার বর্ণনার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে এক মডেল তুলে ধরেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনার সংস্কার, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্তর্জাতিক কর সহযোগিতার বৈশ্বিক কাঠামো, অবৈধ আর্থিক প্রবাহ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অবৈধ ও দুর্নীতিলব্ধ অর্থ ও পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাহীনতায় কঠোর অভিযোগ তোলেন। গত ১৫ বছরে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট অনাগ্রহ ও প্রতিবন্ধতার কথা সু্স্পষ্টভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি বিশ্বের উন্নত দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা অবৈধ অর্থ পাচারে সহযোগিতা ও উৎসাহিত করছে বলে বিশ্বদরবারে কঠোর অভিযোগ দায়ের করেন বাংলাদেশ প্রধান উপদেষ্টা।
এমনকি তাদের নেহায়েত কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসার আহ্বান করে ড. ইউনূস বলেন, ‘যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান এ পাচারকৃত সম্পদ গচ্ছিত রাখবার সুযোগ দিচ্ছে, তারা যেন এই অপরাধের শরিক না হয়- এ সম্পদ তার প্রকৃত মালিককে অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের নিকট ফিরিয়ে দিন। আমি উন্নয়নশীল দেশ হতে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধি বিধান প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিতের প্রস্তাব করছি।’
তিনি জানান, রাজস্বখাতে ঐতিহাসিক সংস্কারের পাশাপাশি মুদ্রাবিনিময়, ব্যাংকখ্যাত ও পুঁজিবাজার সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে সহজ করার জন্য বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু করেছে। এর কার্যক্রম সাবলীলভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষগুলোকে একই ছাদের নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট প্রক্রিয়াও সহজ করা হয়েছে। এ সময়ে তিনি বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রবাসীদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এছাড়াও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও আলোচিত হয়েছে।
জাতিসংঘের সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশ্ব পরিবর্তনে তরুণ প্রজম্মের অবস্থান তুলে ধরেন এই অর্থনীতিবিদ। পাশাপাশি তাদের বিনিয়োগমুখী করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ ও এআই, প্রযুক্তি নির্ভরতার ব্যবহারে সফলতা ও ক্ষতির দিকেও গুরুত্ব দেন। উনবিংশ শতাব্দীতে ক্ষুদ্রঋণের বৈপ্লবিক আবিষ্কার ও দারিদ্র নিরসনে তার ভূমিকার কথা উত্থাপন করেন। জলবায়ু ও বিশ্ববাণিজ্য সংকটকের পেছনে ১২০টি দেশে চলমান সশস্ত্র সংঘাত দায় করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট উত্তরণের অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ চালু করার জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান করেন।
রোহিঙ্গা ইস্যুকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে এই সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক আর্থিক তহবিল ব্যবস্থা করার পাশাপাশি দায়িত্বশীলদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা, আর তাদের পরেই বৃহত্তম ভুক্তভোগী হলো বাংলাদেশ। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপাক্ষিক বিষয় নয়। আমরা শুধু একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে আমাদের মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছি।’
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে আলাদা করে ফুটে উঠেছে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তারের উদ্বেগ, বিস্তাররোধ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে ও দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক অঞ্চলমুক্ত করে বিশ্ব অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলো পুনর্জীবিত করা। সেইসঙ্গে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পারমাণবিক অবস্থান সুস্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘আমরা পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের যে অধিকার প্রতিটি দেশের রয়েছে তার প্রতি সমর্থন জানাই’।
তিনি বলেন, একটি দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে আমাদের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার আগেই, এই বছর আমরা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার আওতাধীন পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত যৌথ কনভেনশনে যোগদান করেছি। এই যোগদানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মানের পারমাণবিক নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার প্রতি আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি।
বিশ্বনেতাদের সামনে সবচেয়ে বলিষ্টতার সঙ্গে সতর্কবার্তা দিয়ে ফিলিস্তিনিদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মানবেতর জীবনযাপনের জন্য দখলদার ইসরায়েলকে দায়ী করেন প্রফেসর ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছি, কখনো ভয় দেখিয়ে কিছু করা আমি সমর্থন করিনি। কিন্তু আজ আমাকে সেখান থেকে সরে এসে ভয়ংকর কিছু কথা বলতে হচ্ছে। আজ আমি সতর্ক করছি, চরম জাতীয়তাবাদ, অন্যের ক্ষতি হয় এমন ভূরাজনীতি এবং অন্যের দুর্ভোগ ও পীড়নের প্রতি ঔদাসীন্য বহু দশকের পরিশ্রমে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি তা ধ্বংস করে দিচ্ছে।’
‘এর সবচেয়ে মর্মান্তিক চিত্র আমরা দেখছি গাজায়। শিশুরা না খেয়ে অকাল মৃত্যুবরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সঙ্গে আমরাও একমত যে আমাদের চোখের সামনেই একটি নির্বিচার গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে; আমাদের দুর্ভাগ্য যে মানবজাতির পক্ষ থেকে এর অবসানে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।’
বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমি আবারও জোরালো দাবি জানিয়ে বলেন, ‘পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ সমস্যার দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধুমাত্র ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমারেখার ভিত্তিতে, যেখানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকবে, তখনই ন্যায়বিচার সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হবে।’
এ সময় বিভিন্ন দেশে সংঘাত, যুদ্ধ সংঘর্ষ নিরসনে জাতীসংঘের আওতায় শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অবদানের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি সকল বর্ণ ও মতের প্রতি সহিঞ্চুতা বজায় রাখার আহ্বান করেন। সেইসঙ্গে একবিংশ শতাব্দীতে ইসলামবিদ্বেষীদের স্থান নেই বলেও বিশ্ব আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের কাছে কঠোর বার্তা উপস্থাপন করেন। এছাড়া নারীর অবদান ,অধিকার ও শান্তি নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতার কথা তুলে ধরেন।
সবশেষ ‘থ্রি জিরো’ বা ‘তিন শূন্য’ তত্ত্বের বাস্তবতা তুলে ধরে বক্তব্য শেষ করেন নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদেরকে তিন শূন্যের পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তরুণরা তিন শূন্য বাস্তবায়নের সৈনিক হয়ে বড় হবে। তাদের সামনে থাকবে শূন্য কার্বন, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব; এর ভিত্তিতে তারা গড়ে তুলবে তাদের পৃথিবী। তিন শূন্যের পৃথিবী গড়া জাতিসংঘের সকলের স্বপ্ন হোক— এ কামনা ব্যক্ত করে আমার বক্তব্য সমাপ্ত করলাম।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন