ঢাকা শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৫

যে কারণে বারবার পেছাচ্ছে বেগম জিয়ার লন্ডনযাত্রা 

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৫, ২০২৫, ০৬:৫১ পিএম
ছবি- সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ তিনি। সর্বশেষ গত ২৩ নভেম্বর শ্বাসকষ্ট হলে তাকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর তার শরীরের নানা জটিলতা বিবেচনা করে চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি করে নেন। এভারকেয়ারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাকে গত ২৭ নভেম্বর সিসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ঢাকা আসা এবং বেগম জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য নেওয়া নিয়ে চলছে বিস্তর টানাপোড়েন।

বেগম জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকেই সেখানে ভিড় করছেন নেতাকর্মীরা। বিএনপির শীর্ষপর্যায়, সারা দেশের রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিসচেতন মহলের পক্ষ থেকে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য দোয়া প্রার্থনা করা হচ্ছে।

এর মধ্যে বেগম জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে যাতে কোনো বিভ্রান্তি না ছড়ায় সে জন্য বিএনপির মিডিয়া সেলের পক্ষ থেকে অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন (আবু জাফর মোহাম্মাদ জাহিদ হোসেন)-কে তার চিকিৎসার বিষয়ে একমাত্র বক্তব্য দানকারী হিসেব নিশ্চিত করা হয়। ডা. জাহিদ একাধারে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। সেই সাথে তিনি বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকও।

ডা. জাহিদ এর আগে একাধিকবার সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টিই নির্ভর করে তার শারীরিক অবস্থার পর। তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন।

পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ায় যুক্তরাজ্য ও চীন থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল দেশে আসে। বৃহস্পতিবার (০৪ ডিসেম্বর) এভারকেয়ার হাসপাতালে তাদের নিয়ে বৈঠকে বসে খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ড। বৈঠক শেষে দুপুর আড়াইটার দিকে এভারকেয়ারের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এসে ডা. জাহিদ হোসেন জানান, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড।

খালেদা জিয়ার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কি না জানতে চাইলে ডা. জাহিদ বলেন, ‘পরিস্থিতি আগের থেকে উন্নতি হয়েছে। আমরা আপনাদের আগেও বলেছি, মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শের বাইরে কোনো অবস্থাতেই উনার পরিবার অথবা আমরা দল কোনো অবস্থাতেই কোনো চিন্তা করছি না। আমরা এখনো অনেক আশাবাদী।’

এরপর শুরু হয় টানাপোড়েন। জানা যায়, কাতার রাজপরিবারের বিশেষায়িত এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এ-৩১৯ আসছে। (চলতি বছরের ০৭ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির দেওয়া এই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করেই লন্ডনে নেওয়া হয়েছিল। চিকিৎসা শেষে চার মাস পর ০৫ মে একই এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দেশে ফেরেন তিনি।) গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলো, গতকাল দিবাগত রাত অথবা আজ সকালে লন্ডনের উদ্দেশে উড়াল দেবেন বেগম জিয়া। এরপর খবর প্রকাশ হলো তার পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান আসছেন। এরপর জানা গেল, কারিগরি ত্রুটির জন্য আসছে না কাতারের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স।

শুক্রবার সকালে বিএনপি মিডিয়া সেল থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস রিলিজে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, কাতারের আমিরের দেওয়া এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে যান্ত্রিক ত্রুটিই শুধু নয়, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লন্ডনে যাওয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার শারীরিক অবস্থাও।

তিনি বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) থেকে ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ভালো না। এয়ারক্র্যাফটের সমস্যা আছে, একই সঙ্গে শারীরিক অবস্থাও ভালো না। এই অবস্থায় যাত্রার তারিখ বদল করা হয়েছে। এখন মেডিকেল বোর্ড বললে, ফ্লাই করার মতো থাকলে রোববার তাকে লন্ডনে নেওয়া হবে।’

বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে জানানো হয়, কারিগরি ত্রুটির কারণে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স না আসায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাত্রার সময় পিছিয়ে গেছে। তাকে বহন করার জন্য কাতারের আমিরের পক্ষ থেকে বিশেষ যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি আজ শুক্রবার ঢাকায় আসার কথা ছিল, সেটি নির্ধারিত সময়ে আসছে না। এর ফলে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার বিষয়টি পিছিয়ে রোববার ০৭ ডিসেম্বর হতে পারে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘কারিগরি ত্রুটির কারণে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স শুক্রবার আসছে না। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে এটি শনিবার পৌঁছাতে পারে। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা যদি যাত্রার জন্য উপযুক্ত থাকে এবং মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত দিলে, ইনশা আল্লাহ ৭ তারিখ (রোববার) তিনি লন্ডনের উদ্দেশে রওনা দেবেন।’

এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী জোবাইদা রহমান ইতোমধ্যে লন্ডন থেকে ঢাকায় পৌঁছেছেন। বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে যান।

সবশেষ খবর, কাতার নয়, জার্মানি থেকে আসছে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করছে কাতার সরকার। শুক্রবার (০৫ ডিসেম্বর) কাতার দূতাবাস জানায়, কাতার আমিরের আয়োজনে আগামীকাল (শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টায় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি ঢাকায় অবতরণ করবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় ‘অবতরণ অনুমতি’ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। সব ঠিক থাকলে, বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভ্রমণ-উপযোগী থাকলে রোববার লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ডা. জুবাইদা রহমান ছাড়াও থাকবেন ডা. জাহিদ হোসেন, ডা. এনামুল হক চৌধুরী (চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা), ডা. ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী, ডা. সাহাবুদ্দিন তালুকদার, ডা. নুরুদ্দিন আহমেদ, ডা. মো. জাফর ইকবাল, ডা. মোহাম্মদ আল মামুন থাকবেন। চিকিৎসক দলের বাইরে খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ সৈয়দা শামিলা রহমান, তারেক রহমানের সহকারী মো. আব্দুল হাই মল্লিক, খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব মো. মাসুদুর রহমান এবং গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম ও রুপা শিকদার। এ ছাড়াও এসএসএফের দুজন সদস্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন।

উল্লেখ্য, বহু বছর ধরেই খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস এবং চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। এর আগে, ২০২১ সালের মে মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন তিনি। তখনো শ্বাসকষ্টে ভোগার কারণে তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের জুনে তার হৃৎপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয়। তখনো তিনি মূলত হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছিলেন, যা তার শারীরিক অবস্থাকে জটিল করে তুলেছিল। এর আগে থেকেই তার হার্টে তিনটি ব্লক ছিল। আগে একটা রিংও পরানো হয়েছিল। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুনে পোর্টো সিস্টেমেটিক অ্যানেসটোমেসির মাধ্যমে খালেদা জিয়ার লিভারের চিকিৎসাও দেওয়া হয়েছে বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে।

অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে এভারকেয়ার হাসপাতালের ১২ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড খালেদা জিয়ার চিকিৎসার তদারক করছে। চীন ও যুক্তরাজ্য থেকেও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে এসে মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। এই মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তেই খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন নেওয়া হচ্ছে।