বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আলাউল কবীর

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪, ০২:০১ পিএম

বুদ্ধি লোপ পেলে কী হবে

আলাউল কবীর

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪, ০২:০১ পিএম

বুদ্ধি লোপ পেলে কী হবে

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

‘কী করে দিন গেল রে আমার কী করে দিন গেল-
দিন যে আমার ভাটা পড়ে এল...
দিন যে আমার ভাটা পড়ে এল।’

কথাটা প্রায়ই বলত আমাদের গায়ের বায়তুল্লাহ মিয়া। তিনি একজন বুদ্ধিদ্বীপ্ত জ্ঞানী লোক ছিলেন। তখন ১৯৬৬ সাল, মেট্রিক পরীক্ষায় জামালপুর মহকুমায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। একজন সাধারণ পরিবারের সন্তান কিন্তু চিন্তায়, মননে, ভাবনায় জ্ঞানের পরিসীমা ছিল অসাধারণ। তারপর সময়ের বিবর্তনে কোনো এক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে তার ভেতর মানসিক পরিবর্তন আসে। তখন থেকেই গাঁয়ের লোক তাকে ‘বয়তুল্লাহ পাগল’ বলত। কারণ একটাই শ্লীলতা কিংবা অশ্লীলতা যা-ই ঘটুক না কেন সে নির্ভয়ে সব সত্য, ন্যায় ও উচিত কথা বলত। সে মানুষকে সহসা বলে দিত কে স্বাধীনতাবিরোধী, কে প্রত্যক্ষ হত্যাযজ্ঞ করেছে, কেই-বা এসবের ইন্ধন জুগিয়েছে অথবা কাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, কার পেছনে কে লেগেছে, কে কীভাবে সমাজসেবা করে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই হয়তো তার উপাধি হয়েছিল একজন পাগল। বলতে গেলে তাকে এক শ্রেণির সুবিধাবাদীরা পাগল বানিয়ে রেখেছিল। এ ধরনের স্বার্থান্বেষীরা সবসময় নিজেদের এভাবেই দৃষ্টিগোচর করে রাখে বা রাখার চেষ্টা করে।

এ-তো গেল বয়তুল্লাহ পাগলের কাহিনি। আর আমরা এহেন দৃষ্টিগোচর মানুষকে সেবা করি, তার দাসত্ব মেনে নিই, তার কথা-লেখা-বলায় সব কিছুকেই বাহবা দিই। আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাটাই কেন যেন তাদেরই অর্ঘ্য রচনা করি, ধ্বনিতে ধ্বনিতে মুখরিত করি রাজপথ। আমরা যেন কিছুই বুঝি না, যারা একটু একটু বোঝার চেষ্টা করি, ঠিক তখনই তারা নিষ্পেষিত-কলঙ্কিত। ঠিক তখনই আর একটি পাগল বনে যাই। এখন শুধু বলতে ইচ্ছে করে, আমরা যারা প্রতিবাদী, নির্ভীক চিত্তের অধিকারী, সাহসী, তারুণ্যের উচ্ছলতায় তেজদীপ্ত । প্রত্যেকেই এক একজন পাগল। আমরা হয়তো বুঝি না, আমাদের বোঝার প্রয়োজন বোধটাও মনে করে না কেউ। স্বাধীন রাজ্যে পরাধীন কিংবা নিজগৃহে পরবাস। যেখানে পানি এবং দুধের মূল্য এক, যেখানে নিত্যদ্রব্য হু হু করে বেড়েই চলেছে। যেখানে পুঁজিবাদীরা দিব্যি বহমান রেখেছে তাদের ধারা, ঠিক সেখানেই আমি পাগল বটে; কিন্তু পাগলামি নেই। কারণ গণতন্ত্রের কথা বলতেই মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো এক অশনিসংকেত  কাজ করে যাচ্ছে দিব্যি, এখনো।

প্রতিবাদ! (‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’) আর প্রতিবাদ মানেই আরও একজন নূর হোসেনের উত্থান।

সুতরাং একটা শ্রেণি শুধু গড়েই চলেছে রাজ্য, একের পর এক। রাজত্ব তাই তার মতো চলে। তার পরিধি সম্প্রসারিত হচ্ছে সময়ের তালে তালে। খুব ব্যস্ততম মানুষ তারা। নিচের দিকে তাকানোর সময় কোথায়! কে খেয়েছে-কে খায়নি, কে হাত বাড়িয়েছে কে দাঁড়িয়েছে, কে ভিখারি সাজে সেজেছে, এসব দেখবে কে? রামকৃষ্ণ বলতেন- ‘ঈশ্বরের যদি ঐশ্বর্য না থাকত, তাহলে কোনো বেটা তারে মানত?’ সত্যি। এ রাজ্যে অনেক ঈশ্বরের দাপট। আমরা যতবেশি আধুনিক থেকে আধুনিকতর হচ্ছি, ততবেশি প্রগৈতিহাসিক বর্বর চিত্তের ভাবাবেগে ফিরে যাচ্ছি। তফাৎ শুধু একটাই তখন মানুষগুলো যার যার কথা ভাবত একেবারেই না বুঝে, আর এখন তার নিজেকে কেন্দ্র করে বিশাল পরিধি নির্ভর তারই নিজস্ব ব্যাপ্তির সার্বিক ধ্যান-ধারণাকে চিন্তা করে বুঝে-শুনে। অন্য কোনো স্বাধীনতাকে প্রাধান্য না দিয়েই কেবল স্বীয় চরিতার্থ সার্থক করার নিমিত্তে মত্তমাত্র একেই বলে শিক্ষিত বর্বরতা। কী করে পেরিয়ে যাব এই গণ্ডি, কী করে গড়ে তুলব সভ্যতার পূর্ণতা।

আমরা সভ্যতার কথা বলেই যাই। দেশ গড়তে যা যা করণীয়, আমরা দরাজ গলায় তা আওড়াতে থাকি। কিন্তু অন্তরে পুষে রাখি রাষ্ট্রদ্রোহিতার কর্মকাণ্ড। পাচার করি অর্থ নির্দ্বিধায়, পড়ে থাকুক শূন্য থলে জাতীয় অর্থকোষে; কার কী আসে যায়। সবাই কেমন যেন অর্থলিপ্সু দানবের এপিঠ-ওপিঠ। শিক্ষিত এই সমাজে বড় বড় বুদ্ধিজীবীর দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চুপ। স্বার্থান্বেষী মহলের আনাগোনা চারদিকে। সমাজ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।

যিনি সমাজ সম্পর্কিত জটিল চিন্তা-চেতনতাকে ধারণ করে, গবেষণা ও প্রভাব বিস্তারের ন্যায় বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে জড়িত থাকেন। প্রাত্যহিক কর্মে যেসব দক্ষতায় সমাজের অবক্ষয় নির্র্মূলের দিকনির্দেশনা দেয় বা শিল্প-সাহিত্যকে বেগবান করে তোলে এবং নানান বিষয়ে ভালো পরামর্শ দিয়ে থাকেন আমরা তাদেরকেই মূলত বুদ্ধিজীবী বলে আখ্যায়িত করি। এরাও এখন ফ্যাসিবাদীদের তাণ্ডবে ভিন্ন জগতের মানুষ বলে দাবি করে নিজেদের।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুণী ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের নির্মূল করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আাল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের  নিজগৃহ থেকে তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করেছে। মূল উদ্দেশ্যই ছিল জাতিকে নির্মূলে ধ্বংস করা। সমাজের প্রতিটি দিক থেকেই এর প্রতিফলন ঘটিয়েছে। শিক্ষক-দার্শনিক, সাহিত্যিক-ঐতিহাসিক, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক প্রভৃতি সব শাখাতেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে একদম পরিকল্পিতভাবে। ‘বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস’ এর পৃষ্ঠা নং-৩৭৪ এর সূত্র ধরে সম্ভবত ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ নিকোলাস টোমালিনের একটি প্রতিবেদন-

‘বৃহস্পতিবার ঢাকায় আত্মসমর্পণ করার আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজধানীতে তখনো বেঁচে থাকা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। বিশিষ্ট বাঙালি নাগরিকদের নিশ্চিহ্ন করার সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ঝটিকা সামরিক অপারেশন চালিয়ে এ কাজটি করা হয়। কাজেই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজিসহ পাকিস্তানি হাইকমিশনার এ ব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় অবগত ছিল।

বুদ্ধিজীবীদের এই লাশ পাওয়ার ঘটনা ঢাকাতে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে। এতে প্রতিশোধমূলক হত্যা ও দাঙ্গার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সংঘাতও  সৃষ্টি হতে পারে। হত্যাকাণ্ডের শিকার বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলো পাওয়া যায় নগরীর উপকণ্ঠের রায়ের বাজারে এক ডোবায়। আমি সেখানে ৩৫টি লাশ দেখেছি। পচনশীল লাশগুলো দেখে মনে হয়, ৪ থেকে ৫  দিন আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে। তবে আরও অনেককেই হয়তো এভাবে হত্যা করা হয়েছে। অপহরণের খবর অনুযায়ী অনেকে ধারণা করেছেন, নিহতের সংখ্যা ১৫০ পর্যন্ত হতে পারে।’ 

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১; চলমান দেশের গতিকে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে এই হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১; প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েও পূর্ণতা মেলেনি। অপুষ্টিতে ভোগা একটি অপূর্ণ রাষ্ট্র এই বাংলাদেশ।

এর পরেও আমরা সচেতন নই। আগ্রাসন একের পর এক আসতেই থাকে এবং তা এখনো চলমান, শুধু প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সম্প্রতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রূপ ভিন্ন হতে চলেছে। একজন সচেতন নাগরিক তার বিন্দুমাত্র রক্ত থাকতে দেশের স্বাধীনতার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবে না। ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট ২০২৪ আরেক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এই বাংলাদেশ। অনিয়ম, মানবিক অবক্ষয়, দুর্নীতি, লুণ্ঠন- এসব দেখে দেখে মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাই। সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে দেশের স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করি। আমি পাগলের মতো দেশকে ভালোবাসি। পাগল নই কিন্তু পাগলামি তো আছে! এই পাগলামি সমস্ত দুর্নীতি-আগ্রাসনকে গুঁড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম গতিশীল রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর করায় প্রতিটি নাগরিকের প্রকৃত লক্ষ্য থাকা বাঞ্ছনীয়।

আরবি/এফআই

Link copied!