বৃহস্পতিবার, ০১ মে, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


লাভা মাহমুদা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪, ১০:৩৫ এএম

আলোকধারা যেন না হারায়, আঁধারের তলদেশে

লাভা মাহমুদা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৭, ২০২৪, ১০:৩৫ এএম

আলোকধারা যেন না হারায়, আঁধারের তলদেশে

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে কি না, মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে বা এই সমাজের মানুষের হৃৎজগত ও মানসিকতা দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। মানুষ দ্রুতই অসামাজিক হয়ে উঠছে, বেড়ে যাচ্ছে অসহিষ্ণুতা। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা লেগেছে, পারিবারিক পরিমণ্ডলে। প্রিয়জন, স্বজনেরা দ্রুতগতিতে ছিটকে যাচ্ছে আপন বলয় থেকে। ন্যায়-অন্যায়বোধ হারিয়ে কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত আচরণ করছে।

আধুনিক সময় ও সমাজে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বিশ্বায়নের ঢেউ আছড়ে পড়েছে এ দেশেও। অর্থনীতির সূচকগুলো যেমন ওপরে উঠছে, তেমনি জীবনমান বাড়ছে; বাড়ছে চাহিদাও। এখন আর অল্পে তুষ্ট নয় অধিকাংশ মানুষ। ভোগবাদী জীবনব্যবস্থা ভালো না খারাপ, সে বিবেচনা সময়ই করবে। তবে সারা পৃথিবীর মানুষ এক ছাদের নিচে চলে আসছে এ কথা মানতে হবে, মানুষে মানুষে যোগাযোগ বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি, শিক্ষার প্রসার ঘটছে; এটা অবশ্য ইতিবাচক দিক। পৃথিবী এগিয়ে যাবে আর আমরা পিছিয়ে থাকব, তা তো হয় না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা ‘সামাজিক’ হলেও ব্যক্তি জীবনে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। পরিবারগুলো ভেঙে অণু হতে হতে পরমাণুতে রূপ নিচ্ছে। চারপাশে দৃষ্টি রাখলে সবচেয়ে কষ্ট এবং অস্বস্তিকর যে বিষয়টি ঠেকছে, তা হচ্ছে মা-বাবাকেন্দ্রিক।

আমরা পৃথিবীতে এসেছি, মা-বাবার মাধ্যমে। তাদের হাত ধরেই এ পৃথিবীর আলো দেখা, চলতে শেখা, এগিয়ে যাওয়া। আমাদের ছন্দবদ্ধ বহতা জীবনের উৎস তো তারাই। অথচ কী অবলীলায় আমরা (অধিকাংশই) তাদের অবহেলা-অনাদর, অসম্মান করছি! এ সমাজে বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে আছে, যারা তাদের মা-বাবার দায়িত্ব পালনে ইচ্ছুক নয়। আতঙ্কের বিষয়, সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে।

অবস্থানগত কারণে শহরাঞ্চলে প্রকটভাবে প্রকাশ না পেলেও গ্রামের আঁচটা ব্যাপকভাবেই গায়ে লাগে। বৃদ্ধ মা-বাবার আহাজারি, চোখের জল, দারিদ্র্য, চিকিৎসার অভাব, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব আর কষ্ট মিলেমিশে অসহনীয় এক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে পরিবারগুলোয়। আগে এটি অশিক্ষিত নিম্নবিত্ত পরিবারে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারগুলোকেও গ্রাস করেছে, তা অনেকটা মহামারির মতো।

প্রায়ই আমরা দেখতে পাচ্ছি সন্তান, বিশেষ করে ছেলে সন্তান বিয়ের পর পরই বা বিয়ের কিছু দিনের ভেতরেই মা-বাবা থেকে পৃথক হয়ে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা সংসার গড়ছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে মা-বাবা থেকে। পরম প্রিয় মা-বাবা হয়ে যাচ্ছে ‘বিরাট বোঝা’। দায়িত্ব নিতে প্রকাশ্যে অপারগতা প্রকাশ করছে। মা-বাবার সঙ্গে একসঙ্গে থাকাকে উটকো ঝামেলা মনে করছে এ প্রজন্মের কেউ কেউ।

সম্প্রতি ‘প্রাইভেসি’ শব্দটি বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত। এই প্রাইভেসি নষ্ট হওয়ার দায়ে, খরচের বোঝা বহন করতে না পারার দায়ে, বাসা বা বাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ার দায়ে, প্রজন্মগত অমিলের দায়ে মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা আলাদা করে দেওয়ার বিষয়টি এখন আর শুধু দৃষ্টান্ত বা নজির হিসেবে থাকছে না, ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সবখানেই।

সন্তানকে লালনপালন করতে, মানুষ করতে জীবনের সর্বস্ব বিসর্জন দেন মা-বাবা। খেয়ে না খেয়ে মুখে তুলে দেন আহার, দামি খাবারটা, ভালো খাবারটাও সযত্নে তুলে রাখেন সন্তানের জন্য। সন্তানের কল্যাণ কামনায় সবসময় আকুল প্রার্থনায় মশগুল থাকেন মা-বাবা। সন্তানের সাফল্যে সবচেয়ে বেশি যারা আনন্দ পান, গর্বে বুক ফুলে ওঠে, সে তো মা-বাবাই। ব্যর্থতায় ততোধিক কষ্ট পান, সেও মা-বাবা।

সন্তানের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখেই বাসস্থান বানালেন বাবা, কষ্টের উপার্জিত অর্থের অনেকখানি সঞ্চয় করে রাখলেন সন্তানের সুখের জন্য অথচ সেই বাড়িতে জায়গা হয় না তাদের। সম্পদ, বাড়ি, অর্থ গ্রাস করে বৃদ্ধ মাকে টেনেহিঁচড়ে কাঠগড়ায় তুলতেও দ্বিধা নেই অনেক সন্তানের। মা-বাবা একসময় অপাঙক্তেয় হয়ে যায়।

সব সম্পত্তি লিখে নিয়ে মা-বাবাকে বাড়িছাড়া করার উদাহরণ এখন অনেক। ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে বন্ধন-স্নেহ, আদর-ভালোবাসা, আস্থা ও বিশ্বাস।

এসব নিয়ে নানা বিশ্লেষণ আছে। সমাজবিজ্ঞানীরা এক ধরনের বিশ্লেষণ দেন, মনোবিজ্ঞানীরা আরেক ধরনের; অর্থনীতিবিদরা হয়তো ভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণ দেন। কিন্তু মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে কোনো বিশ্লেষণই গ্রহণযোগ্য বা যথেষ্ট নয়।
এটা তো সে সম্পর্ক নয়; এটা আত্মার সঙ্গে আত্মার বন্ধন, প্রাণের সঙ্গে নাড়ির যোগ, রক্তঘাম দিয়ে প্রজন্ম সৃষ্টি। এটাতে হিসাব-নিকাশের সীমা-পরিসীমা থাকবে না, পারে না বিচার-বিশ্লেষণযোগ্য কোনো কারণও। এ সম্পর্ক শর্তহীন-স্বার্থহীন, অকৃত্রিম-অম্লান।

কন্যাসন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশ জটিল। বাঙালি সমাজে মেয়েরা মা-বাবার পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়েছে, এ সংখ্যা নেহায়েত হাতে গোনা। কৌশলগত ও বাস্তব কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মেয়েরা মা-বাবার দায়িত্ব নিতে পারছে না।

এ পৃথিবীর আলো দেখার আগে থেকে মা-বাবা পরম মমতায়, নিবিড় যত্নে আগলে রাখেন মাতৃকোঠরে, নতুন দিনে নব সূর্যালোকে সাদরে আহ্বান জানান অদেখা ভুবনে। নিশ্চিত নিরাপত্তা দেন, নিশ্চয়তা দেন বেড়ে ওঠার কালে। বুকের সঙ্গে বুক রেখে বড় করতে থাকেন, গায়ের সঙ্গে গা সেঁটে, হাত ধরে পথ চলতে শেখান। অথচ সেই মা-বাবার যখন অবলম্বন প্রয়োজন হয়, তখন সেই সন্তানই মুখ ফিরিয়ে নেয় দ্বিধাহীন ও নির্লিপ্তভাবে। ফলে বৃদ্ধাশ্রমগুলোর চাহিদা বাড়ছে পাশ্চাত্যের মতোই। দিনে দিনে উন্নতির নামে আমাদের মানসিক দৈন্য যত বাড়তে থাকবে; বৃদ্ধাশ্রমগুলো ততই পূর্ণ হবে।

আবার অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা রয়েছে এমন মা-বাবারা কেবল সন্তান সঙ্গের জন্য আকুল হয়ে প্রতীক্ষা করেন। একটা সময় যখন বুঝতে পারেন নিজের অস্তিত্ব থেকে বেড়ে ওঠা হৃদপিণ্ডটা কখন যেন অন্য কারো দখলে চলে গেছে, তখন করুণ হাহাকারে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিইবা করার থাকে। কিন্তু কেন এতটা নৈতিক অবক্ষয়? কেন এত লোভ-হিংসা, অসম্মান?
সমাজে প্রচলিত আছে, স্ত্রীর প্ররোচনায় স্বামী নিজের মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কথাটা কিছুটা সত্য, সম্পূর্ণ নয়। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষেরা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্ত্রীর মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখেই মা-বাবাকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে পারে। অন্য পরিবার থেকে আগত মেয়েটিকে যেমন আপন করে নিতে হবে পরিবারের সবাইকে, তেমনি মেয়েটিকেও বুঝতে হবে মা-বাবার সঙ্গে তার স্বামীর সম্পর্ক একেবারেই শর্তহীন এবং স্বার্থহীন; ঠিক যেমন মেয়েটির সঙ্গে তার নিজের মা-বাবার সম্পর্ক। একই পরিবারে একসঙ্গে থাকতে গেলে সমস্যা অস্বাভাবিক নয়, মতের অমিল হতে পারে, প্রজন্মগত পার্থক্য তো থাকবে তবে সেটাকে পুঁজি করে বিবাদের সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা অবশ্যই অন্যায়।

পাশ্চাত্যের অনেক ভালো দিক যেমন রয়েছে, তেমন আবার আত্মিক বন্ধনের দিকটা দুর্বল; এটি মোটেও সুখকর নয়। সেখানে বিশেষ দিবসগুলোয় সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার যোগাযোগ হয়। অনেকটাই কৃত্রিম আবরণে মোড়ানো সে সম্পর্কগুলোয় উপহারের নামে ‘উপহাস’ আসে, ভালোবাসার নামে আসে দীর্ঘশ্বাস। তবে সেখানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পাশে, নিরঙ্কুশ মানবিক অবস্থান নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মা-বাবার প্রাপ্য সম্মান-শ্রদ্ধার জায়গাটা নিরঙ্কুশ রাখা অবশ্যই জরুরি। খেয়াল রাখা প্রয়োজন, সেই জায়গাটাতে যেন আঘাত না লাগে। তাদের শরীরের পাশাপাশি মনেরও যত্ন নেওয়া দরকার। বুঝতে হবে, এটি পরম্পরা। বয়স হলে নিজেদেরও কিন্তু একসময় সেই সন্তানের কাছেই আশ্রয় নিতে হবে।

সবকিছুর আগে আঙুল তুলতে হবে নিজের দিকে। সমস্যার শেকড়টা সন্ধান করতে হবে। আসলে আমাদের সন্তানদের কী শেখাচ্ছি? আমরা তাদের পুঁথিগত বিদ্যায় যতটা পারদর্শী করে তুলতে আগ্রহী, নৈতিকতায় ঠিক ততটাই নই।

লেখাপড়া ও পরীক্ষায় ভালো ফল চাই, গোল্ডেন ফাইভ চাই, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড় কর্তা, চাই অর্থ বিত্ত যশ প্রতিপত্তি। চাইতে সমস্যা নেই, সময়ের দাবি। কিন্তু সবকিছুর আগে চাইতে হবে, ভালো মানুষ গড়ার প্রত্যয়। শুধু কাগজ-কলমে নীতিবাক্য শেখানো নয়, শুধু বইয়ের পাতার তত্ত্বকথা গলাধঃকরণ নয়, জীবনের বাস্তবতায় নৈতিকতার ব্যবহারিক প্রয়োগ শেখাতে হবে। সেটার প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান নিজের পরিবার, মা-বাবা, পারিবারিক আবহগত পরিবেশ। তারপর আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ভালো বই এবং পারিপার্শ্বিকতার ভূমিকা।

মনে রাখতে হবে- ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে।’

আপনার সন্তান; ছেলে হোক, মেয়ে হোক- শৈশব থেকেই সেই মূল্যবোধে গড়ে তুলতে হবে, যাতে সব হিসাব-নিকাশের বাইরের বিশুদ্ধ, স্বার্থহীন অমলিন এ সম্পর্কের মর্যাদা সে বোঝে, সম্মান করতে শেখে। মা-বাবার দায়িত্ব পালনের জন্য সন্তানকে যদি আইন-আদালত দেখাতে বা বোঝাতে হয়, তা হবে জীবনের বিপুল পরাজয় ও মনুষ্যত্বের অবমাননা।

আরবি/এফআই

Link copied!