ঢাকা শনিবার, ০২ আগস্ট, ২০২৫

মতামত

প্রধান উপদেষ্টা বরাবর খোলা চিঠি

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২৫, ০১:০২ পিএম
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি- সংগৃহীত

বিষয়: স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জরুরি প্রয়োজনীয়তা এবং তা ‘জুলাই চার্টার ২০২৫’-এ অন্তর্ভুক্তির আবেদন

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা,

আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করছি।

জাতির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আপনি নেতৃত্বের গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন—যা শুধু প্রশাসনিক নয়, এক গভীর নৈতিক দায়ও বহন করে। আমরা আপনার এ দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আপনার দূরদর্শী নেতৃত্ব বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় একটি নতুন অধ্যায় রচনা করবে—যেখানে রাষ্ট্রপরিচালনার মান হবে আরও স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক।

স্বাস্থ্য খাত কোনো একক মন্ত্রণালয় বা সেবার সীমায় আবদ্ধ নয়। এটি জাতীয় উন্নয়নের মূল স্তম্ভ—যা মানবসম্পদের বিকাশ, সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সমঅধিকারের মূল ভিত্তি গঠন করে। একটি কার্যকর, ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া জাতির উন্নয়ন কল্পনাও করা যায় না।

আমরা অকপটে স্বীকার করি যে, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও সত্য যে, একগুচ্ছ গভীর কাঠামোগত দুর্বলতা, শাসনব্যবস্থায় বিচ্যুতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতার অভাব আমাদের এই অগ্রযাত্রাকে বারবার থমকে দিয়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো এসেছে এক গুরুতর বাস্তবতা থেকে—যা কেবল সেবার সম্প্রসারণ বা গুণগত মান বৃদ্ধির পরামর্শ নয়, বরং এটি একটি সুসংহত রূপরেখা—যার মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের গভীর সমস্যাগুলোর সমাধান, প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন এবং প্রশাসনিক জবাবদিহিতার একটি টেকসই কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব।

তবে অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে—যদি যথাসময়ে সাহসী ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এমন গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো কাগজেই বন্দি থেকে যায়। তাই এখনই প্রয়োজন একটি বাস্তবভিত্তিক, সময়সীমা নির্ধারিত এবং জাতীয়ভাবে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত রোডম্যাপ প্রণয়ন। আমরা বিশ্বাস করি, এই সংস্কারগুলোকে ‘জুলাই চার্টার ২০২৫’-এ অন্তর্ভুক্ত করা হবে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত—যা অতীতের সম্মান এবং ভবিষ্যতের অঙ্গীকারকে একসূত্রে বেঁধে রাখবে।

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা আমরা জানি। কিন্তু সীমাবদ্ধতার মাঝেও দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর প্রশাসনিক নির্দেশনা এবং নৈতিক সাহস নিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আজ জাতির সামনে একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছে—আমরা চাই আপনি সেটিকে বাস্তবায়নে পরিণত করুন।

আমরা বিনীতভাবে নিম্নলিখিত তিনটি অগ্রাধিকারভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি:

১. একটি স্থায়ী স্বাস্থ্য কমিশন গঠন:

একটি স্বাধীন, গণজবাবদিহিমূলক এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন স্বাস্থ্য কমিশন গঠন—যা দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত রূপকল্প ও বাস্তবায়নের নেতৃত্ব দেবে। এই প্রতিষ্ঠান হবে ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য খাত রূপান্তরের মূল চালিকাশক্তি।

২. সার্বজনীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গঠন:

শহর ও গ্রামে বাধ্যতামূলক রেফারেল ব্যবস্থাসহ কার্যকর, মানসম্পন্ন ও বিনা মূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করতে হবে—যা হবে নাগরিক অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি।

৩. উচ্চপর্যায়ের স্টিয়ারিং কমিটি গঠন:

উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে একটি সময়বদ্ধ, দায়িত্বনির্ভর কমিটি গঠন করতে হবে—যা এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের গতি ত্বরান্বিত করবে এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সরাসরি এর তত্ত্বাবধান করবে।

আমাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী, যদি এই পদক্ষেপগুলো আগস্ট-২০২৫ এর মধ্যভাগে শুরু করা যায়, তবে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সরকারি আদেশ/অধ্যাদেশ জারি সম্ভব এবং ২০২৬ সালের প্রথম প্রান্তিকেই জনগণের সামনে কাঠামোগত এই রূপান্তরের দৃশ্যমান অগ্রগতি উপস্থাপন করা যাবে।

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, এটি কেবল প্রশাসনিক কর্তব্য নয়—এটি জাতির প্রতি একটি নৈতিক অঙ্গীকার। এই আগস্ট মাসে, যখন জাতি গণজাগরণ ও আত্মত্যাগের স্মৃতিতে দাঁড়িয়ে, তখন যদি আপনি এই রূপান্তরের সূচনা করেন এবং জুলাই চার্টার-২০২৫ এর অংশ হিসেবে তা ঘোষণা করেন, তবে তা হবে শহীদদের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি এক সাহসী প্রতিশ্রুতি।

আপনার দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন নেতৃত্বে আমরা আশাবাদী যে, আপনি এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে যুগোপযোগী ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে একটি টেকসই ও মানবিক রূপান্তরের পথে নিয়ে যাবেন।

আপনার সদয় বিবেচনা ও জরুরি পদক্ষেপ কামনা করছি।

বিনীতভাবে,

ডক্টর সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন 
সদস্য, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগ
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

ডক্টর সৈয়দ আব্দুল হামিদ
প্রফেসর, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সমন্বয়কারী, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (AHRB)
প্রবর্তক, নেটওয়ার্ক ফর হেলথ কেয়ার এক্সিলেন্স (NHE)

ডক্টর আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন
সদস্য, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন
কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ সাপোর্ট ট্রাস্ট (CCHST)

প্রফেসর ডক্টর লিয়াকত আলী
সদস্য, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন
চেয়ারম্যান, পথিকৃত ফাউন্ডেশন

প্রফেসর ডক্টর নায়লা জামান খান
সদস্য, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন
পরিচালক, ক্লিনিক্যাল নিউরোসায়েন্সেস সেন্টার
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন

ডক্টর আজহারুল ইসলাম খান
সদস্য, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন
প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসক ও হাসপাতাল প্রধান, আইসিডিডিআর’বি