ঢাকা রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

মতামত

ঢাকার বুকে মৃত্যুপুরীর শঙ্কা: জেগে ওঠার শেষ সময়

এস এম ফয়েজ
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৫, ০৩:৫২ পিএম
সিনিয়র সাংবাদিক এস এম ফয়েজ।

ভৌগোলিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ। বিশেষত রাজধানী ঢাকা, এক প্রকাণ্ড ভূমিকম্প ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুভূত হওয়া মৃদু কম্পনগুলো আমাদের জন্য প্রকৃতির এক নির্মম সতর্কবার্তা। বিশেষজ্ঞরা বারবার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন— বড় মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানলে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এই ঢাকা শহর অচিরেই এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হতে পারে। এই শঙ্কা অমূলক নয় বরং এটি এক কঠিন বাস্তবতা। যার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি আমাদের একেবারেই অপ্রতুল।

ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতা ও অপরিকল্পিত নগরায়ন

ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এখানে জনসংখ্যার চাপ যেমন আকাশচুম্বী, তেমনই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে মানা হয়নি কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা বিধিমালা। পুরোনো ঢাকার জরাজীর্ণ ভবন থেকে শুরু করে নতুন ঢাকার আকাশচুম্বী ইমারত—সবকিছুতেই যেন ঝুঁকির ছাপ স্পষ্ট। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বা বিল্ডিং কোড কাগজে-কলমে থাকলেও, এর প্রয়োগ ও তদারকি অত্যন্ত দুর্বল। ফলে অনেক ভবনই ভূমিকম্প সহনীয় নয়।

বড় ভূমিকম্পের সময় এই অপরিকল্পিত অবকাঠামোই হয়ে উঠবে আমাদের প্রধান বিপদ। হাজার হাজার ভবন ধসে পড়বে, সরু রাস্তাগুলো পরিণত হবে ধ্বংসস্তূপের পাহাড়ে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন ছিন্নভিন্ন হয়ে মুহূর্তে সৃষ্টি হবে চরম বিশৃঙ্খলা।

উদ্ধার ব্যবস্থার অপ্রতুলতা

ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মূল দায়িত্বে থাকা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সসহ অন্যান্য জরুরি পরিষেবা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে। যে মাত্রার দুর্যোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক ভারী সরঞ্জাম, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল এবং দ্রুত সাড়া দেওয়ার মতো অবকাঠামো আমাদের নেই।

যানজট ঢাকার এক নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা। ভূমিকম্পের সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে উদ্ধারকারী দলগুলো সময়মতো ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে পৌঁছাতে পারবে না। ফলে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। শুধুমাত্র ফায়ার সার্ভিসের একার পক্ষে এই বিশাল বিপর্যয় সামাল দেওয়া একেবারেই অসম্ভব।

প্রয়োজনীয়তা: সচেতনতা ও প্রস্তুতি

ভূমিকম্প রোধ করা মানুষের সাধ্যের বাইরে, কিন্তু এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সরকারের দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

কঠোর আইন প্রয়োগ: বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সক্ষমতা বৃদ্ধি: উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোকে আধুনিক সরঞ্জাম ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে হবে।

সমন্বিত উদ্যোগ: সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে একটি সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

জনসচেতনতা: প্রতিটি নাগরিককে দুর্যোগকালীন সময়ে করণীয় সম্পর্কে জানতে হবে। নিয়মিত মহড়া এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে।

‘মৃত্যুপুরী’ শব্দটি যেন আমাদের গাফিলতিরই প্রতিচ্ছবি। আমরা জানি ঝুঁকি আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা উদাসীন। এই উদাসীনতা ও অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এক মহাবিপর্যয় ডেকে আনছে। এখনই সময় জেগে ওঠার, পূর্বপ্রস্তুতি নেওয়ার। নতুবা, বড় ভূমিকম্পের আঘাতে যখন কেঁপে উঠবে ঢাকা, তখন আফসোস করারও সময় থাকবে না।

লেখক: এস এম ফয়েজ
সিনিয়র সাংবাদিক