বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


ড. মোহাম্মদ আমীন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২৫, ০৬:০৭ পিএম

শেখ হাসিনার পতনের কারণ

ড. মোহাম্মদ আমীন

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২৫, ০৬:০৭ পিএম

শেখ হাসিনা। ছবি- সংগৃহীত

শেখ হাসিনা। ছবি- সংগৃহীত

ড. মোহাম্মদ আমীন একজন প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও লেখক, যিনি বাংলা ভাষা, বানান ও সাহিত্য বিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন। তিনি ‘শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থের মাধ্যমে ভাষা সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছেন। এ ছাড়া সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণেও সক্রিয়; তিনি ফেসবুক (আকরে) পোস্টে লিখেছেন শেখ হাসিনার পতনের একত্রিশটি কারণ, যা প্রকাশের জন্য আমাদের অনুমতি দিয়েছেন।

এক: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল শেখ হাসিনার প্রথম ভুল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদৌলতে বিপুল জনমত নিয়ে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। অথচ ক্ষমতায় আসার পর জনরায় ও জনগণকে নিজের ইচ্ছেমতো দলিত করার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে বাতিল করে দেন। যা তাঁর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও স্বৈরাচারে উপনীত হওয়ার পথকে প্রশস্ত, সহজ এবং উদ্দীপনায় পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন— এখন তাঁকে আর কেউ দাবায়া রাখতে পারব না। সংগত কারণে আমি মনে করি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সফল কাজটি শেখ হাসিনার এমন করুণ পরিণতিকে অনিবার্য করে তোলার প্রথম পদক্ষেপ। তিনি গণতন্ত্রের প্রতীক থেকে হয়ে উঠেছিলেন চরম স্বৈরাচার। একতরফা নির্বাচন করে দেশের জনগণ এবং যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা বিশ্বকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছিলেন।২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসনে জিতে সরকার গঠন করার পর তিনি ক্ষমতা থেকে বের হতে চাননি এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যখন যা ইচ্ছে তা যতই অন্যায় কাজ হোক করেছেন। এটি তাঁর পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

দুই: অতিরিক্ত অহংবোধ

শেখ হাসিনা ছিলেন অহংকারী। এটি তাঁর স্বামীর কথা। তত্ত্বাবাধয়ক সরকার বাতিল করার পর তিনি আরও অহংকারী হয়ে উঠেন। নিজেকে পরম সার্বভৌম ও অপ্রতিরোধ্য ভাবতে শুরু করেন। অশিক্ষিত মুখরা রমণীর মতো বিবেচনা ছাড়া যখন যা ইচ্ছে তা বলতে থাকেন। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লাগামহীন বক্তব্য প্রদানের পূর্বে যে, ব্যক্তিত্ব বা সুবিবেচনা থাকা অপরিহার্য তাও তিনি ভুলে যান। ফলে ব্যক্তিত্বের মতো সুকুমার বিষয়টি অহংবোধের মতো ঘৃণ্য বিষয়ে পরিণত হয়। জনগণ তাঁর থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে। ভয়ে সামনা-সামনি কিছু না বললেও আড়ালে-আবডালে তাঁর নিকটজনের অন্তরেও শেখ হাসিনার প্রতি ঘৃণ্য মনোভাব উচ্চকিত হতে থাকে। আমার বাংলাদেশ, আমার নিজের বাংলাদেশ, আমার বাবা স্বাধীনতা দিয়েছে- এসব অহংবোধক উক্তি তাঁকে শুধু অজনপ্রিয় নয়, একই সঙ্গে হাস্যকর ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করতে থাকে।

তিন: অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস

ক্ষমতায় আসার সফলভাবে কিছু কিছু কঠিন কাজ নিজের ইচ্ছেমতো বিনাবাধায় খুব সহজে করতে পারায় তাঁর মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। প্রত্যেক কথায় অনুসারীদের হাততালি, অফিসারদের প্রশ্নহীন আনুগত্য, প্রতিবেশী ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রভৃতি তাঁকে বেপরোয়া করে তুলে। ফলে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিলেন। যা ছিল তাঁর পতনের অন্যতম কারণ। তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুর পতনেরও অন্যতম কারণ ছিল অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ছিল অন্যতম। এই আত্মবিশ্বাসের কারণ তিনি বিরোধীদলকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিতেন না। ভাবতেন তারা কিছুই করতে পারবেন না।

চার: নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন

দীর্ঘ সাধনায় বাংলাদেশে নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন একটি জন-আস্থার অবস্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ার আওতায় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা জয়ী হয়। অথচ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা নির্বাচন কমিশনকে অকার্যকর করে তাঁর ইচ্ছার পুতুল বানিয়ে নেন। নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন পরিণত হয় তামাশার বিষয়ে। জনগণের ভোটাধিকার ছিনতাই হয়ে যায় হাসিনার করাল গ্রাসে। ফলে জনগণের আস্থা থেকে তাঁর নাম ক্রমশ অনাস্থার দিকে ধাবিত হতে থাকে। বিভিন্নভাবে শেখ হাসিনা সরকার নির্বাচন কমিশনের সমুদয় গ্রহণযোগ্যতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এটি শেখ হাসিনার হৃদয়-বিদারক পতনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলার আরেকটি কারণ। তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে পুরোদমে নষ্ট করে দিয়েছিলেন।

পাঁচ: উপদেষ্টা/মন্ত্রী নির্বাচন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত দুষ্কৃতকারী এইচ টি ইমামকে নির্বাচন-উপদেষ্টা এবং পরবর্তীকালে জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব প্রদান ছিল শেখ হাসিনার একটি মারাত্মক ভুল। অধিকন্তু, এরূপ অনেককে এভাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করে তিনি নিজের চারপাশ শক্তিশালী করতে গিয়ে বরং দুর্বল করে দিয়েছেন। ব্যক্তিত্বহীন স্তাবকদের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করতেন শেখ হাসিনা । মন্ত্রী বা উপদেষ্টাদের কেউ সত্য কথা বললে কিংবা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উপযুক্ত উপদেশ দিলে এবং তা মনঃপুত না হলে তাঁকে পুরস্কৃত করার পরিবর্তে তিরষ্কৃত করা ও শাস্তি প্রদান তাঁর পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মন্ত্রী ও উপদেষ্টা নিয়োগে তিনি মেধা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, পারদর্শিতা, সততা, সাহসিকতা, দূরদর্শিতা ইত্যাদি বিবেচনা না করে কেবল আনুগত্য বিবেচনা করতেন। ফলে তাঁর চারপাশেও গড়ে উঠে একটা শক্ত বিরোধী বলয়।

ছয়: সমালোচনা

সমালোচনা সহ্য করতে না পারা এবং কেউ সামান্যতম সমালোচনা করলেও তাঁকে নানাভাবে হেনস্তা করা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের একটি শক্তিশালী কারণ। নিজের বা আওয়ামী লীগের প্রতিকূলে সামান্য সমালোচনা শুনলেও তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন। এই ক্ষিপ্ততা তাঁকে ক্রমশ উগ্র ও রগচটা স্বভাবের বাহন করে তুলে। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের যে ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা পরিণত হয় ভয়, অশ্রদ্ধা আর ঘৃণায়।

সাত: বিরেধীদলের প্রতি আচরণ 

বিরোধী দলকে বলা হয় সরকারি দলের অবৈতনিক শিক্ষক। বিরোধী দল সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরে তাকে সতর্ক করে দেয়। সরকারি দল তা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে সংশোধন করে। এজন্য বলা হয়, যে দেশে শক্তিশালী বিরোধীদল নেই সে দেশে সরকারি দল দুর্বল হয়ে যায়, ভুল করে পদে পদে। কিন্তু শেখ হাসিনা ছিলেন এই তথ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং অতিমাত্রায় গরম মাথার নেত্রী। তিনি বিরোধীদলকে বিশ্বাস করতেন না এবং যা বলতেন তাকে মনে করতেন তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এই ভেবে তিনি সর্বদা বিরোধী দলকে প্রচণ্ডভাবে দলন করতেন, তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণেও পিছপা হতেন না। এই কাজে তিনি প্রাথমিকভাবে কিছুটা সফলও হন। ফলে তাঁর ভুল তুলে ধরার কেউ থাকল না। সংগত কারণে তিনি আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে থাকেন।

আট: প্রশাসন

প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কেবল স্তাবকদের পদোন্নতি দেওয়া ছিল শেখ হাসিনার অন্যতম দুর্বলতা। তিনি কেবল তাঁদের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করতেন যারা তাঁর আদেশ কোনো রূপ প্রশ্ন ছাড়া অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করতেন- তা যতই অন্যায় হোক না। এভাবে তাঁদের ওপর তিনি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এসব কাজ তিনি যাদের মাধ্যমে করাতেন তাঁরা অন্যায় করলেও কিছু বলতেন না বলতে পারতেন না। ফলে পুরো প্রশাসন দুর্নীতিতে ছেঁয়ে যায়। বেড়ে যায় খুন-জখম, গুম। ক্রমশ এটি তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়। যখন-তখন প্রশাসন যন্ত্রকে দলীয় ও ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করার ফলে প্রশাসন হয়ে যায় স্থবির এবং জনরাক্ষস।

নয়: গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ ও পদায়ন

সরকারি বিভিন্ন বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ এমনকি পিওন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ মারাত্মকভাবে জেঁকে বসেছিল। অলিখিতভাবে সৃষ্টি হয়েছিল জি ক্যাডার বা গোপালগঞ্জ ক্যাডার, আত্মীয় ক্যাডার, দলীয় ক্যাডার, মাল ক্যাডার। এসব বিবেচনা করে নিয়োগ দিতে গিয়ে প্রশাসন প্রকৃত মেধা হতে চরমভাবে বঞ্চিত হয়। তিনি পান একদল অনুগত স্তাবক আর জাতি পায় একটি মূর্খ প্রশাসন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ছিল আরও জঘন্য।

দশ: পুলিশ প্রশাসন

জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা পুলিশ বাহিনীর প্রধান কাজ। শেখ হাসিনা পুলিশ প্রশাসনকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দায়িত্ব হতে ছিনিয়ে নিজের উদ্দেশ্য-পূরক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেন। যারা তাঁর এমন ইচ্ছাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতে রাজি হতেন না তাঁদের হয়তো চাকুরি হতে বরখাস্ত, নয়তো ওএসডি বা গুরুত্বহীন স্থানে পদায়ন করা হতো। তাঁর অবৈধ ইচ্ছার অনুকুলে কাজ করতে কিংবা বিরোধী শক্তিকে দলনের জন্য পুলিশে সৃষ্টি করা হয়েছিল ফ্রাংকেনস্টাইনের মতো কিছু সংখ্যক রাক্ষস। শেষ পর্যন্ত এসব ফ্রাংকেনস্টাইনই তাঁর এমন পরিণতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শেখ হাসিনা কিছু কিছু কর্মকর্তাকে নিজের অবৈধ কর্মকাণ্ড সম্পাদনে সহায়তা করার জন্য ব্যবহার করতেন। এ লক্ষ্যে তাঁদের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা এবং যা ইচ্ছে তা করার অলিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন। অধিকন্তু, তারা কোনো অন্যায় করলেও দেখে না-দেখার বরং ন্যায্য গণ্যে পুরস্কৃত করা হতো। এসব কর্মকাণ্ড দেশকে চরম অরাজক অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। বেড়ে গিয়েছিল খুন-জখম, হামলা আর গায়েবি মামলা। পুলিশ প্রশাসনকে রাজনীতিক উদ্দেশ্য হাসিল এবং বিরোধী দলকে দমনের জন্য ব্যবহার তাঁর পতনের অন্যতম কারণ।

এগারো: ক্ষমতার ধারাবাহিকতা 

পরপর দুবার ক্ষমতায় আসার পর একই পদ্ধতিতে ভোটহীন নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয়বারও ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার এমন লজ্জাকর পতনের অন্যতম আরেকটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর উচিত ছিল অন্তত তৃতীয় বার এমন কাজটি না-করা। সে বার না জিতলেও পরের বার জিততে পারতেন। তাঁর জানা উচিত ছিল বাঙালিরা এক সরকারকে বেশি দিন দেখতে চায় না। এক তরকারি বেশিদিন কারও ভালো লাগে না। বাঙালি তো এ বিষয়ে খুবই স্পর্শকাতর।

বারো: জনগণকে অবহেলা

মুখে জনগণ-জনগণ করলেও শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে মোটেও বিশ্বাস করতেন না। জনগণের চেয়ে প্রসাশানের বিভিন্ন বিভাগ ও স্তরে সৃষ্ট কিছু কর্মকর্তা এবং দলীয় ক্যাডারের ওপর নির্ভরশীলতাকে নিরাপদ মনে করতেন । জনগণকে অবহেলা করা, তাদের পাত্তা না দেওয়া, ছাত্রলীগকে পুলিশের সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা, তাঁদের হাতে অবৈধ অস্ত্র দেওয়া প্রভৃতি তাঁর এমন ঘৃণ্য পতনের কারণ। শুধু নিজের জন্য নয়, পরিবারের সদস্যদের জন্যও তিনি জনগণকে অবহেলা করতেন। চলফেরার সময় রাস্তাঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জনসাধারণের গাড়ি থামিয়ে রেখে জনগণকে বিরক্তির চরম সীমায় তুলে দিয়েছিলেন। জনগণের অবস্থা নিয়ে মোটেও চিন্তা করতেন না।

তেরো: দুর্নীতির প্রসার

দুর্নীতি দমনে কঠোর না হওয়া, বরং ক্ষেত্রেবিশেষে উৎসাহিত করা; নিজের সুবিধা বিবেচনায় তিলকে তাল কিংবা তালকে তিল করা, নিজের লোক অন্যায় করলেও তাকে ছোটো করো দেখা প্রভৃতি কর্মকাণ্ড দুর্নীতিকে চরম অসহনীয় অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ছিল তাঁর ক্রীড়নক। সংস্থাটিকে দুর্নীতে দমনের পরিবর্তে বিরোধী শক্তিকে হেনস্তা করার জন্য ব্যবহার করা হতো অধিক মাত্রায়।

চৌদ্দ: বিচার ব্যবস্থা

শেখ হাসিনা বিচারব্যবস্থাকে ক্রীড়নকে পরিণত করেছিলেন। ধ্বংস করে দিয়েছিলেন বিচারব্যবস্থা। গুরুত্বপূর্ণ বা তাঁর আগ্রহ আছে এমন কোনো রায় তাঁর কথা বাইরে কেউ দিতে পারতেন না। দিলে তাঁকে হেনস্তা করা হতো। প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত এমন অত্যাচার হতে রেহাই পাননি। তিনি বিচারকদের ইচ্ছেমতো রায় দিতে বাধ্য করতেন।

পনেরো: বঙ্গবন্ধুকে সস্তা করে দেওয়া

যতই মতভেদ থাকুক না, বঙ্গবন্ধুর প্রতি জনগণের একটা আলাদা শ্রদ্ধা ছিল। শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত নেতাকেও বির্তক, ঘৃণা আর অবহেলার পাত্রে পরিণত করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে খ্যাত-অখ্যাত লেখক-প্রতিষ্ঠান হতে হাজার হাজার পুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ, যত্রতত্র ভাস্কর্য স্থাপন, অসংখ্য অবকাঠামোর নামকরণ; জাতীয় পর্যায়ে দৃশ্যত কোনো অবদান না থাকলেও কেবল পরিবারের সদস্য বিবেচনায় তাঁদের নামে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাদির নামকরণ বঙ্গবন্ধুকে খুবই সস্তা, সহজলভ্য ও খেলো করে দিয়েছে। প্রভৃতি কর্মকাণ্ড শুধু বঙ্গবন্ধুকে সস্তা করে দেয়নি একই সঙ্গে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকেও হ্রাস করে তাঁর পতন ত্বরান্বিত করে। বিবেচনাহীন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি আকাশচুম্বী শ্রদ্ধার অধিকারী ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও অতলে তালিয়ে দিয়েছেন তাঁর মতো।

ষোলো: মুখ 

মুখ বা কথা শেখ হাসিনার পতনের অন্যতম কারণ। বৈষম্য-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনায় লাগামহীন কথা তাঁর আসন্ন পতনকে আরও ত্বরান্বিত করে দেয়। জিহ্বা নরম, কিন্তু তার থেকে ছোঁড়া শব্দবাণ প্রচণ্ড ক্ষতিকর। তিনি নিজের অনেক কিছুর মতো জিহ্বাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। জনগণের দারিদ্র্য বা ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে উপহাস করেছেন। মিষ্টি কুমড়ো দিয়ে পিঁয়াজু খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। জনদাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে হাস্যকর বা উপহাসমূলক মন্তব্য করেছেন। ‘রাজাকারের বাচ্চা’, ‘আন্দোলন করে হয়রান হয়ে যাক তারপর কথা বলব’— একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখ হতে এসব কথা নিতান্তই বালখিল্য।

সতেরো: শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন

শেখ হাসিনা নিজের চেয়ে তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর অধিক নির্ভরশীল ছিলেন। নির্ভরশীল না হলেও এমনই প্রকাশ করতেন। সবসময় বলতেন, আমার বাবা এই করেছেন, সেই করেছেন। তিনি যেমন ছিলেন তার পিতার ওপর নির্ভরশীল, তেমনি আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনসমূহ ছিল শেখ হাসিনার ওপর নির্ভরশীল। শেখ হাসিনার সামনে সরকারি যন্ত্রের ক্ষমতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংঠনসমূহের নেতাকর্মীরা লাফালাফি করতেন, কিন্তু তাঁরা আসলে ছিলেন মাকাল ফল, লোভী, ভীরু কিন্তু নৃশংস— ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদর ঘাট।

আঠারো: খুন গুম অত্যাচার 

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর যত লোক খুন হয়েছেন, গুম হয়েছেন তা নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। যাদের প্রিয়জন খুন বা গুম হয়েছেন শুধু তারা নয়, বরং যারা শুনেছেন তারাও শেখ হাসিনাকে নৃশংস ভাবতে শুরু করেন। জনগণ তার মধ্যে ভালোবাসা দেখতে পেতেন না, দেখতে পেতেন হিংস্রতা। তাঁদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন জালিম শাসক, স্বৈরাচার। খুব সামান্য কারণেও তিনি অনেক বিদ্বান মানুষকে অমানুষিক যন্ত্রণায় দগ্ধ করেছেন, আটক অবস্থায় হত্যা করেছেন।

উনিশ: ঋণ অর্থ পাচার

অনেকে বলেন, তিনি দেশের জন্য অনেক কিছু করেছেন, অনেক উন্নয়ন করেছেন; সত্য বলতে কি আমি কিছুই দেখি না। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একটি কথা আছে, “পেঁদে নাই থ্যানা, মিডা দি হানা।’’ যাকে বলা যায়, আসলে মুষল নেই, ঢেঁকি ঘরে চাঁদোয়া। অনাহারক্লিষ্ট মানুষের অন্নের সংস্থান না করে সেটেলাইট প্রকল্প-সহ এমন সব প্রকল্প নিয়েছেন যা দেশেকে কমপক্ষে একশ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। ধার করে কিছু অবকাঠামো নির্মাণ উন্নয়ন নয়, বরং অবনমন। বিলিয়িন-বিলিয়ন ডলার ঋণ করে তিনি দেশকে এগিয়ে দেওয়ার নাম করে পশ্চাতে নিয়ে গেছেন। অথচ উৎপাদনমুখী কিছু করেননি। ফলে দেশে বেড়েছে বেকারত্ব। শেখ হাসিনার শাসনামলে যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে তার কিয়দংশও যদি উৎপাদনমুখী শিল্পকারাখানা প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা হতো তাহলে বেকারত্বের এমন প্রচণ্ড হাহাকার থাকত না। তিনি তা না করে দুর্নীতির প্রসার ও কিছু লোককে সুবিধা দেওয়ার জন্য ঋণ করে ঘি খাইয়েছেন।

বিশ: মিথ্যাচার

শেখ হাসিনা জনগণের সঙ্গে সঠিক কথা খুব কমই বলতেন। তিনি কেবল নিজের দিকটা দেখতেন এবং সেভাবে মিথ্যা বলে জনগণকে তুষ্ট করার কিংবা দোষস্খালনের চেষ্টা করতেন। তিনি ভাবতেন জনগণ তুষ্ট হয়েছেন, তাঁর কথা বিশ্বাস করেছেন— কিন্তু তিনি জানতেন না যে, জনগণ তাঁর চেয়ে চালাক। এমন ব্যবহারের কারণে তিনি প্রথমে ধীরে ধীরে এবং অবশেষে খুব দ্রুত জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেন। তার মিথ্যাচার তাঁকে শুধু সরকার প্রধান হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও ঘৃণিত করে তুলে।

একুশ: ক্ষমতার লোভ

তিনি ছিলেন ধর্ষকামী (sadist) এবং মারাত্মক ক্ষমতালোভী। ক্ষমতার প্রচণ্ড লোভ তাঁর হিতাহিত বোধ সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিয়েছিল। ক্ষমতার জন্য, ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি মানবীয়-অমানবীয় সবকাজ করতে পারতেন। এমন অপরিমিত লোভ তাঁর পতনের অন্য সব অনুষঙ্গকে উদ্দীপ্ত করে দিয়েছিল। এই অতি লোভই একের পর এক তাঁর অন্য অপরাধ/ভুলসমূহের জন্ম দিতে থাকে । ফলে তাঁর এমন লজ্জাকর পতন অনিবার্য হয়ে উঠে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস ও পতনের অন্য একটি কারণ।

বাইশ: ভারততোষণ

শেখ হাসিনা ছিলেন অতিমাত্রায় ভারত নির্ভর একজন ধূর্ত কিন্তু পরাশ্রয়ী মহিলা। ভারতমাতা ছিল তাঁর রক্ষাদেবী। তিনি মনে করতেন, ভারত অনুকূলে থাকলে দেশের মানুষ তাঁর কিচ্ছুটি করতে পারবে না। এই অতিরিক্ত ভারততোষণের কারণে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁর প্রতি বিরূপ হয়ে যায়। এটি শেখ হাসিনার এমন পতনের অন্যতম কারণের অন্যতম একটি।

তেইশ: গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ

শেখ হাসিনার পতনের আরেকটি কারণ হলো তাঁর কৃতদাস হিসেবে পরিচালিত গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ। তিনি নিজের অপকর্ম (খুন জখম দুর্নীতি, অবিচার, জনগণের প্রতি অবহেলা, অত্যাচার) ঢাকা দেওয়ার জন্য গণমাধ্যম ও কথিত সুশীলদের ব্যবহার করতেন। কাউকে অর্থ দিয়ে আবার কাউকে ভয় দেখিয়ে কিনে নিয়েছিলেন। জনগণএটিও ভালোভাবে নেননি। তাঁর এমন কাজ বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতি সাধারণ জনগণের ঘৃণা আর অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের মতো এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তিনি শেষ করে দিয়েছেন।

চব্বিশ: অনুসারীদের সঙ্গে সম্পর্ক

শেখ হাসিনা তার অনুসারীদের মনে ভয়, লোভ, প্রাপ্তি, দেনাপাওনা, নৃশংসতা প্রভৃতি সৃষ্টি করতে পেরেছেন, তাঁর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারেননি। তিনি বিরোধীদের দমনের জন্য দলের লোকজনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করেছেন, যারা যত সন্ত্রাসী তাঁদের তত বেশি পুরস্কৃত করেছেন। ফলে তারা ক্রমশ সন্ত্রাসী হয়ে উঠেছেন— জনদরদি হয়ে উঠতে পারেননি। এজন্য সাধারণ জনগণ তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সন্ত্রাসীদের জন্য জনগণ শেখ হাসিনার নৌকায় উঠতে পারেননি, তাঁর কাছে যেতে পারেননি। ফলে নেত্রী আর জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল দূরত্ব। যা তাঁর এমন অবমাননাকর পতনের অন্যতম কারণ। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের লোকজন তাঁকে সর্বোচ্চ নেত্রী হিসেবে ভয় করতেন, সামনাসামনি বুকভাঙা ভালোবাসাও দেখাতেন, কিছু পাওয়ার জন্য প্রচণ্ড ভক্তিও দেখাতেন, কিন্তু ভালোবাসতেন না মোটেও। ফলে বিপদ দেখে নিজেদের বাঁচানোর জন্য নেত্রীকে অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যান। নেত্রীকে অনুসারীদের কাছে মাতৃরূপে অধিষ্ঠিত হতে হয়, শেখ হাসিনা তা পারেননি। ফলে তাঁর বিপদে পার্টির লোকজন সন্তানের মমতা নিয়ে তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসার প্রেরণা, ইচ্ছা বা সাহস কোনোটাই পাননি।

পঁচিশ: ইসলামি দল ও দুই নৌকায় পা 

শেখ হাসিনা নীতিগতভাবে ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ। এই আলোকে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি কিছু ইসলামি দলকে নিষিদ্ধ করে দেন। অন্যদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার মোহে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে হেফাজতকে অবারিত সুযোগ সুবিধা দিয়ে কোলে টেনে নেন। এটি ছিল তাঁর নিজের, দলের আর প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা। শেখ হাসিনার এমন কাজ প্রথম থেকে ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে তাঁর যে সদ্ভাব ও নিবিড় আস্থার সম্পর্ক ছিল তাতে ফাটল ধরায়। আবার, নিজের স্বার্থ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখামাত্র হেফাজতের বিরুদ্ধে নৃশংস ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। ফলে প্রায় সবকটি ইসলামি দল তাঁর ঘোর শত্রু হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রায় ৮৭% নাগরিক মুসলিম। সংগত কারণে অধিকাংশ লোক তাঁর বিরুদ্ধে চলে যেতে থাকে। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠীর অনেকেও তাঁর ওপর আর আগের মতো আস্থা রাখতে পারছিলেন না। যা তাঁকে প্রকৃত অর্থে দুর্বল ও অরক্ষিত করে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে ধর্মপক্ষতা মিশে তাঁর সরকার হয়ে উঠেছিল কৃত্রিম ও ভঙুর।

ছাব্বিশ: বিভাজন 

আওয়ামী লীগ বনাম রাজাকার: শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীবর্গের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের জনগণকে পরস্পর-বিরোধী দুটি ভিন্ন শিবিরে বিভক্ত করে দিয়েছিল— প্রথমটি আওয়ামী লীগ এবং দ্বিতীয় আওয়ামী বিরোধী বা অন্য দল বা যা আওয়ামী লীগ করেন না তারা। যারা আওয়ামী লীগ করতেন না বা আওয়ামী বিরোধী তাঁদের বলা হতো রাজাকার, স্বাধীনতা বিরোধী। ফলে শেখ হাসিনার দলের শক্তি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। বিরোধী দল বা ভিন্নমতের কাউকে, বিশেষ করে ইসলামি দলের সঙ্গে সম্পৃক্তদের রাজাকার, দেশদ্রোহী, স্বাধীনতা-বিরোধী প্রভৃতি নেতিবাচক অভিধায় আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা পক্ষান্তরে দেশের সিংহভাগ মানুষকে তাঁর প্রতি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন। একজন সরকার প্রধানের পতনের জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী লাগে!

সাতাশ: হাইকোর্টের রায়

হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াত গঠিত বেঞ্চ কর্তৃক ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জুলাই প্রদত্ত রায় বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনের প্রধান উৎস। এই আন্দোলন শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছে। ওই রায়ে বলা হয়েছে, “২০১২ খ্রিষ্টাব্দে করা ২৩৫ নম্বর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের জারীকৃত রায় ও আদেশ এবং যে রায়টি ২০৬২/২০১৩ নম্বর লিভ টু আপিলের মাধ্যমে সংশোধিত আকারে আপিল বিভাগে বহাল রাখা হয়েছে, সেই রায়ের আলোকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতিদের কোটা পুনরায় বহাল করার নির্দেশ দেওয়া হলো এবং একই সঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী, উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ অন্য যদি থাকে সেক্ষেত্রে কোটা বহাল রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো।” এই রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়।

আটাশ: কোটা বা বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনকোটা বা বৈষম্য-বিরোধী

আন্দোলনের সন্তোষজনক সমাধান প্রদানে ব্যর্থতা শেখ হাসিনার এমন ন্যক্কারজনক পরিণতির চূড়ান্ত কারণ। তিনি ব্যর্থ হয়েছেন তার অহংবোধ আর মাত্রাতিরিক্ত আস্থার জন্য। আন্দোলনকারীদের প্রতি স্বভাবজাত উপহাসমূলক মন্তব্য, রাজাকার সম্বোধন প্রভৃতি তাঁর পতনকে অনিবার্য করে তোলে। যার যত ক্ষমতা তাঁকে তত বেশি বিনয়ী ও সহনশীল হতে হয়, শেখ হাসিনা ছিলেন এর উলটো। ক্ষমতার প্রসার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উগ্রতা বেড়ে যাচ্ছিল, বেড়ে যাচ্ছিল অন্যকে তুচ্ছ করার মানসিকতা। তিনি নিজে ও নিজের পরিবারের সদস্যবর্গ ছাড়া বাংলাদেশের বাকি সবাইকে মনে করতেন তৃণতুচ্ছ আবর্জনা। ফলে জনগণও তাঁকে অনুরূপ ভাবতে শুরু করেন।

উনত্রিশ: গণহত্যা 

অনেক গণহত্যা তিনি ঘটিয়েছেন। নানা অপকৌশলে রক্ষাও পেয়েছেন সাময়িক। তবে সাময়িক রক্ষা পেলেও জনমনে তাঁর বিরুদ্ধে সৃষ্ট অসন্তোষ ক্রমশ বেড়েছে। সর্বশেষ কোটা বিরোধী আন্দোলনে নির্বিচার শিক্ষার্থী হত্যা শেখ হাসিনার পতনকে নিশ্চিত করে তুলে। এই কাজ দেশ-বিদেশে এত তীব্র ঘৃণা আর অসন্তোষ সৃষ্টি করে যে, সেনাবাহিনীও তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ফলে এতদিন এত অনুকূল উপাদান থাকা বা সৃষ্টি করা সত্ত্বেও শেখ হাসিনাকে আবর্জনার মতো পরিত্যাজ্য হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়। শেখ হাসিনার প্রতি জনমনে কত তীব্র ঘৃণা আর অসন্তোষ জমা হয়েছিল তা তাঁর বিরুদ্ধে জনগণের উচ্চকিত স্লোগানের ভাষা থেকে কিছুটা অনুধাবন করা যায়।

ত্রিশ: সেনাবাহিনী 

ওপরে বর্ণিত এক বা একাধিক কারণে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা অতলে চলে যাওয়া এবং প্রচণ্ড জনবিচ্ছিন্নতার কারণে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে সেনাবাহিনী অসম্মতি প্রকাশ করে। ফলে তার পতন হয়ে যায়।

একত্রিশ: অকৃতজ্ঞতা 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদৌলতে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাই তার উচিত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকা; এই ব্যবস্থা বহাল রেখে নিরাপদে ক্ষমতায় আরোহণ ও অবস্থানের পথ অবারিত রাখা কিন্তু তিনি তা না করে অকৃতজ্ঞের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিলেন। আসলে, সেদিনই তার করুণ পতনের বীজ রোপিত হয়ে গিয়েছিল। সেই বীজ ধীরে ধীরে মহিরুহ হয়ে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে এসে তাঁকে মাটিতে মিশিয়ে দিল। শুধু তাই নয়, অন্যান্য বিষয়েও তিনি অনেক প্রবীণ নেতার সঙ্গে অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করেছেন। যাঁরা তাঁকে বিপজ্জনক কাজ হতে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছেন বা দিতে চেয়েছেন তাঁদের অতীত উপকারিত ভুলে গিয়ে রূঢ় আচরণ করেছেন, অপমান করেছেন। নিমকহারামের পরিণতি সবসময় এমন নৃশংসই হয়।

লেখক: ড. মোহাম্মদ আমীন

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!