বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


এম রায়হান ইসলাম

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২৫, ০৯:১২ পিএম

চট্টগ্রাম বন্দর চুক্তি : বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা 

এম রায়হান ইসলাম

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২৫, ০৯:১২ পিএম

চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি- সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি- সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ এখান দিয়ে সম্পন্ন হয়। এমন একটি কৌশলগত স্থাপনার দক্ষতা ও আধুনিকায়ন কতটা জরুরি—তা বহুদিন ধরেই আলোচনায়। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) পরিচালনায় অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক অপারেটর বা যৌথ অংশীদার যুক্ত করার উদ্যোগ তাই নতুন বিতর্কের জন্ম দিলেও সম্ভাবনার দিগন্ত আরও বড় করে দেয়।

সঠিক নীতিমালা, রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক সুরক্ষা ও অপারেশনাল স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে যদি এ ধরনের চুক্তি বাস্তবায়ন করা যায়, তবে তা বাংলাদেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের দীর্ঘদিনের একটি সমস্যার নাম অপারেশনাল ধীরগতি। জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনগুলো প্রায়ই বাড়তি খরচ বহন করে, আর এর চাপ পড়ে আমদানিকারক-রপ্তানিকারকদের ওপর। কিন্তু আধুনিক অপারেটরের দক্ষ ব্যবস্থাপনা, অটোমেশন এবং প্রযুক্তিনির্ভর মনিটরিং যুক্ত হলে বন্দরের প্রতিদিনকার কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। দ্রুত লোড-আনলোড, উন্নত লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা ও পণ্য চলাচলের স্বচ্ছতা পুরো অর্থনীতির গতি বদলে দিতে পারে। এতে ব্যবসায়ী ব্যয় কমবে, আমদানি–রপ্তানি প্রক্রিয়া আরও দ্রুত হবে, এবং বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বাড়বে।

একটি দেশের বন্দরের সক্ষমতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে অন্যতম প্রধান সূচক। এনসিটি ও সিসিটির আধুনিকীকরণ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপারেশনাল পদ্ধতি চালু হলে বাংলাদেশ নতুনভাবে বিনিয়োগের মানচিত্রে জায়গা করে নিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে এমন স্থানে অবস্থিত যে, চট্টগ্রাম বন্দর সহজেই আঞ্চলিক লজিস্টিক হাবে পরিণত হতে পারে। 

ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার এই অঞ্চলের বড় বাজার, আর তাদের ট্রানশিপমেন্ট চাহিদা যদি বাংলাদেশ আকর্ষণ করতে পারে, তবে এর আর্থিক লাভ সরাসরি দেশের রাজস্ব, বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং কর্মসংস্থানে প্রতিফলিত হবে। এ ছাড়া উন্নত বন্দর সুবিধা থাকলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো শিল্পকারখানা স্থাপনে আগ্রহী হয়, ফলে ইকোনমিক জোন, গুদাম, লজিস্টিক পার্ক এবং শিল্পাঞ্চল—সব ক্ষেত্রেই নতুন বিনিয়োগ বাড়বে।

চুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্ক শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। অনেকের ধারণা এমন চুক্তি হলে শ্রমিক বেকার হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র দেখায়। আধুনিক টার্মিনাল পরিচালনায় নতুন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হয়, যা শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। শ্রমিকরা তখন আগের তুলনায় উচ্চ দক্ষতা ও বেশি বেতনভিত্তিক কাজে যুক্ত হতে পারেন। 

পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং, আইটি, লজিস্টিক, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, নেভিগেশনসহ বিভিন্ন পেশায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। টার্মিনাল যত সম্প্রসারিত হবে, বন্দরের বাইরের খাত যেমন পরিবহন, গুদাম, সরবরাহ শৃঙ্খল, কাস্টমস ক্লিয়ারিং—সবখানেই বাড়তি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বৃদ্ধির দিকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আন্তর্জাতিক অপারেটরদের সঙ্গে চুক্তিতে কনসেশন ফি, মুনাফার ভাগ, বন্দর ব্যবহারের ফি এবং কার্গো হ্যান্ডলিং বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। যখন একটি বন্দর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক হয়, তখন তার ব্যবহারও বহুগুণ বাড়ে। এতে শুধু রাজস্ব নয়, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও বাড়ে। এ অর্থ দেশের মেগাপ্রকল্প, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামাজিক বিনিয়োগেও সহায়তা করতে পারে।

অন্যদিকে, প্রযুক্তি ও দক্ষতা স্থানান্তর দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য বড় সম্পদ হবে। বিদেশি অপারেটররা সাধারণত বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি, ট্র্যাকিং সিস্টেম, সফটওয়্যার এবং নিরাপত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তাদের সঙ্গে কাজ করলে স্থানীয় জনশক্তি এসব প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারে। এটি শুধু বর্তমান বন্দরের জন্য নয়, ভবিষ্যতে দেশীয় বন্দর বা টার্মিনাল পরিচালনার সক্ষমতা তৈরিতেও সহায়ক হবে।

আধুনিক টার্মিনাল মানেই দ্রুত পণ্য পরিবহন, নির্ভরযোগ্য সাপ্লাই চেইন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা বৃদ্ধি। আগামী দিনের অর্থনীতি হলো ‘স্পিড ইকোনমি’। যে দেশ যত দ্রুত পণ্য সরবরাহ করতে পারে, সে দেশ তত বেশি রপ্তানি অর্ডার পায়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ, জাহাজ, ইলেকট্রনিক্স—সব রপ্তানি খাতই গতি-নির্ভর। চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন তাই সরাসরি এসব খাতের সক্ষমতা বাড়াবে।

সবশেষে বলা যায়, এনসিটি–সিসিটির চুক্তি বাংলাদেশকে নতুনভাবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে নিতে পারে। এটি শুধু বন্দর পরিচালনার বিষয় নয়; এটি দেশের মোট অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, বিনিয়োগ প্রবাহ এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

সঠিক পরিকল্পনা, শ্রমিকের অধিকার রক্ষা, রাষ্ট্রীয় নজরদারি এবং চুক্তির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে এই উদ্যোগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের অন্যতম বড় চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশ্বমানের করতে হবে এখনই—এটাই সময়ের দাবি এবং এনসিটি–সিসিটি চুক্তি সেই উন্নয়নের বাস্তব সম্ভাবনা এনে দিতে পারে।  

Link copied!