মালয়েশিয়ায় কর্মসংস্থানের আশায় দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর চুক্তি অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র না মেলায় চরম ভোগান্তির শিকার হন শ্রমিকরা। শ্রমিককে নির্ধারিত সরকারি হারের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ফি পরিশোধ করেছিলেন। এর পরও হয় তারা যেতে পারেননি কিংবা মালয়েশিয়ায় গিয়ে চরম শোষণের মুখে পড়েছেন। হাজারো বাংলাদেশি শ্রমিক বর্তমানে মানবিক সংকটে রয়েছেন। প্রতিদিন আটক হচ্ছেন, জরিমানা দিয়ে ট্রাভেল পাশ কেটে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
বর্তমানে অনেক কোম্পানির শত শত শ্রমিক অনিয়মিত অভিবাসী হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যে টাইটান কোম্পানির মো. শিমুল, মো. রাব্বি, মো. কারিম, মো. তুহিন, ফয়সাল কবির এ রকম শতশত বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রায় দেড় লাখ টাকা দিয়েও ভিসা না পেয়ে অবৈধ অভিবাসীর তকমা নিয়ে পুলিশের ভয়ে দিন পার করছেন। প্রতারিত হওয়া শ্রমিকরা বলেন, মালয়েশিয়াতে আসার পর শুরু থেকে আমাদের কোম্পানিতে কোনো কাজ ছিল না। আমরা তো আর সত্যায়ন বুঝি না, যে কোম্পানিতে কাজ নাই সেই কোম্পানিতে শ্রমিক সরবরাহের অনুমতি কিভাবে দিলো হাইকমিশন?
টাইটান ম্যানেজমেন্টের আরেক কর্মী গাইবন্ধার আনোয়ার বলেন, ‘কলিং ভিসায় কুয়ালালামপুরের বিমানবন্দরে আসার পরে রহমান তনু নামের এক ব্যক্তি নিজেকে রাজনৈতিক নেতা দাবি করে বলেন, ‘তোমাদের বস আমি। কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবা’। পরবর্তীতে তনুর সাথে যোগাযোগ করলে খারাপ ব্যবহার করে বলে তোমাদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে পৌঁছানো দায়িত্ব ছিলো আমার। এ ছাড়া আমার আর কোন দায়িত্ব নেই।’
কুমিল্লার অহিদ বলেন, ‘টাইটান ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির অনেক লোক বর্তমানে ভিসা জটিলতায় ভুগছেন। কেউ কেউ বর্তমানে অবৈধ হয়ে গেছেন, আবার কেউ সাড়ে চার থেকে ৫ হাজার মালয়েশিয়ান রিংগিত দেবার পরেও মালিকপক্ষের কর্মীরা, কর্মীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়তই সময় চাচ্ছেন।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত কলিংয়ের মুলিয়াওয়ান এনার্জি কোম্পানি ১ হাজার ১০০ শ্রমিককে পাঠানোর সত্যায়ন দেন দূতাবাস। পরবর্তীতে এই লোকগুলো কাজ না পেয়ে দেশটির জোহরবারু প্রদেশে মানবেতর জীবনযাপন করেন। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ার টিভি-পত্রিকাতে নিউজ প্রকাশ হলে আদালতে মামলা হয়। আদালতের রায় কর্মীদের পক্ষে হলেও সেই ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়নি। তাহলে কিসের বিনিময়ে দূতাবাস এক দিনে একই কোম্পানির ১ হাজার ১০০ লোকের সত্যায়ন করে দিলেন প্রশ্ন থেকে যায়।
এ ছাড়াও টাইটান ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ৬৮০ জন শ্রমিকের সত্যায়ন দিয়েছিলো দূতাবাস। পরবর্তীতে সেই কোম্পানিতে যাওয়া শতশত বাংলাদেশি শ্রমিক ভিসা না পেয়ে অনিয়মিত অভিবাসী হয়ে মানবতার জীবন যাপন করছেন।
অভিযোগ উঠেছে ভুয়া বা অকার্যকর নিয়োগকর্তার কাগজপত্র দূতাবাস থেকে সত্যায়ন পাওয়ার সুযোগেই এক ধরনের প্রতারণার পথ সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে শ্রমিকরা অবৈধ অবস্থান, আটক বা কর্মহীনতার মতো চরম পরিস্থিতিতে পড়ছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কর্মহীন কোম্পানিগুলোর নামে দূতাবাসে লিখিত অভিযোগ থাকার পরেও মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে মিলে মিশে কর্মহীন কোম্পানিগুলোর সত্যায়ন অনুমোদন করেন দূতাবাস।
সংশ্লিষ্ট একাধিক শ্রমিক ও অভিবাসন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, অনেক শ্রমিক বৈধ ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়ায় গেলেও আগমনের পর দেখা যাচ্ছে তাদের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন, বন্ধ বা শ্রমিক গ্রহণে অস্বীকৃত। এতে তারা শুরু থেকেই অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকির মুখে পড়ে যান। কেউ কেউ জানান, নিয়োগকর্তা খুঁজে না পাওয়া, কাগজপত্রে অসংগতি এবং এক সেক্টরের ভিসা নিয়ে অন্য সেক্টরে জোরপূর্বক কাজে পাঠানোর চেষ্টা—এসব কারণে অনেকের ভিসা বৈধ থাকলেও তারা অবৈধভাবে বিবেচিত হচ্ছেন।
শ্রমিকদের অভিযোগ, যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়া সত্যায়ন দেওয়ার ফলে চাকরির নিশ্চয়তা থাকে না, তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করে মালয়েশিয়াতে আসার পরে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে যান। যার ফলে প্রতিনিয়ত শ্রমিকরা আটক হচ্ছেন, বৈধ কাগজ পত্র না থাকায় অবৈধর তকমা লাগিয়ে ভয়ে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হওয়ার ঘটনাও সামনে আসছে প্রতিদিন।
অভিবাসন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ আখতারুজ্জামান বলেন, ‘সত্যায়নের ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও কঠোরতা না থাকায় কর্মহীন কোম্পানিতে নিয়োগকর্তারা সহজেই শ্রমিক সংগ্রহের ছাড়পত্র পেয়ে যান। সেইসব শ্রমিকরা আসার পরে তাদের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। দূতাবাসের অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। ভবিষতে মালয়েশিয়াতে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে যাচাই প্রক্রিয়া শক্তিশালী করা, শ্রমিক পাঠানোর আগে কোম্পানির সত্যতা নিশ্চিত করা এবং দুই দেশের সমন্বয় জোরদার করা জরুরি।
ভুয়া সত্যায়ন, নজরদারির অভাব, দালাল সিন্ডিকেটের প্রতারণার অভিযোগের পেছনে ভূমিকা রয়েছে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার। এমন অভিযোগের বিষয়ে লেবার কাউন্সিলের সৈয়দ শরিফুল ইসলামের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে লাইন কেটে দেন। পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের ২১ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর ধারাবাহিক শোষণ ও বঞ্চনা অব্যাহত থাকায় জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে জাতিসংঘ একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে দুর্নীতি, অতিরিক্ত অর্থ আদায়, জবরদস্তিমূলক কর্মস্থল পরিবর্তন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে।
কিন্তু এত অভিযোগ ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগের পরেও অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। বরং অভিযোগের কাঠগড়ায় থাকা দায়ীদের শাস্তির নিশ্চয়তা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছ তদন্তের বিষয়ে সরকারের নীরবতা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন